সুকুমার রায়ের ‘মূর্খ মাছি’ কবিতায় আমরা দেখেছি, মাকড়সা মাছিকে এ রকম লোভ দেখিয়ে তার জালে টেনে আনছে। ‘হাওয়ায় দোলে জালের দোলা, চারদিকে তার জান্‌লা খোলা’—মাকড়সার জাল আমরা সবাই দেখেছি। বাড়ির আনাচকানাচ, ঘরের কোণ, অনেক দিন হাত না দেওয়া বইয়ের তাক—সব জায়গায়। ভালো করে খেয়াল করলে আমরা দেখতে পাব, বিভিন্ন রকমের মাকড়সা বিভিন্ন নকশার জাল বোনে। এই মাকড়সার জাল আমরা চাইলেই খুব সহজে পরিষ্কার করে ফেলতে পারি। কিন্তু যদি বলা হয় যে মাকড়সার জাল সঠিকভাবে তুলনা করলে ইস্পাতের চেয়েও শক্ত ও মজবুত—বিশ্বাস হবে? অবিশ্বাস্য মনে হলেও ব্যাপারটা সত্যি।

মাকড়সা নিজের শরীর থেকে রেশমের মতো সুতা বের করে জাল তৈরি করে বিভিন্ন নকশার। এই জালগুলোর নির্দিষ্ট জ্যামিতিক আকার আছে, উদ্দেশ্য আছে। সাধারণ ধারণা থেকে আমরা সবাই জানি, মাকড়সা এই জাল দিয়ে খাবার জোগাড় করে। তাদের জালে পোকামাকড় আটকে পড়ে আর মাকড়সা তা খায়। বিজ্ঞানীরা অনেক বছর ধরে গবেষণা করে মাকড়সার জাল সম্পর্কে এমন সব বৈজ্ঞানিক তথ্য আবিষ্কার করেছেন, যা অত্যন্ত চমকপ্রদ। মাকড়সার জালে রয়েছে একটুখানি জীববিজ্ঞান, একটুখানি রসায়ন এবং অনেকখানি পদার্থবিজ্ঞান।

মাকড়সার শরীরের নির্দিষ্ট গ্রন্থি থেকে জাল তৈরির তরল উপাদান বের হয়। বাতাসের সংস্পর্শে এসেই তা বিশেষ ধরনের সূক্ষ্ম সুতায় পরিণত হয়, যা দিয়ে মাকড়সা জাল তৈরি করে। মাকড়সার গ্রন্থিগুলো শরীর থেকে প্রোটিন সংগ্রহ করে এই সুতার উপাদান বানায়। এই উপাদানের প্রক্রিয়াটা রসায়নের অন্তর্ভুক্ত। প্রোটিন মূলত অ্যামিনো অ্যাসিড, যা কার্বন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন ও অক্সিজেনের রাসায়নিক শিকল। মাকড়সার জালের এই রাসায়নিক শিকল খুবই লম্বা। এই শিকল তৈরি হয় দুটি সবচেয়ে ছোট আকারের অ্যামিনো অ্যাসিড—অ্যালানিন (C3H7NO2) ও গ্লাইসিন (C2H5NO2)। অ্যালানিন ক্রিস্টাল আকারে একটার সঙ্গে একটা খুব শক্তভাবে লেগে থাকে এবং জালের গঠনকে মজবুত করে। আর মাকড়সার জালের অত্যাশ্চর্য স্থিতিস্থাপকতা আসে গ্লাইসিন অণু থেকে। পরপর পাঁচটি গ্লাইসিন অণু আর তার সঙ্গে অ্যালানিন যোগ হয়ে অনেকটা স্প্রিংয়ের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে লম্বা মজবুত জৈবসুতা তৈরি হয়। এগুলোই মাকড়সার জালের উপাদান।

মাকড়সা তাদের জাল দিয়ে অনেক ধরনের কাজ করে। জালে আটকা পড়া শিকারকে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে নির্জীব করে ফেলার জন্য একধরনের সুতা; শিকার জালে পড়লে লাফিয়ে যেন চলে যেতে না পারে, সে জন্য আরেক ধরনের সুতা; নিজের জাল থেকে নিজে যেন পড়ে না যায়, সে জন্য নিরাপত্তা সুতা; জাল থেকে সুতা বেয়ে ঝুলতে ঝুলতে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার জন্য একধরনের সুতা; বাসা বানানোর জন্য একধরনের সুতা; ডিম পাড়ার জন্য একধরনের সুতা; আবার বংশবৃদ্ধির জন্য সঙ্গীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য বিশেষ ধরনের সুতা। মাকড়সা বিভিন্ন রাসায়নিক শিকলে প্রয়োজন মতো অ্যামিনো অ্যাসিডের অনুপাত পরিবর্তন করে এসব বিভিন্ন ধরনের সুতা তৈরি করতে পারে। বিভিন্ন ধরনের সুতা তৈরির জন্য বিভিন্ন ধরনের গ্রন্থি থাকে মাকড়সার শরীরে। শিকার ধরার জন্য যে সুতা তৈরি করে, সেই সুতার স্থিতিস্থাপকতা এত বেশি যে স্বাভাবিক দৈর্ঘ্যের চেয়ে টেনে চার গুণ লম্বা করলেও এই সুতা ছেঁড়ে না। মাকড়সা জালের চারপাশে এবং মাঝখানে যে নিরাপত্তা সুতা ব্যবহার করে, তাকে ড্র্যাগলাইন সিল্ক বলা হয়। মাকড়সাকে কেউ আক্রমণ করলে মাকড়সা এই মোটা সুতা বেয়ে পালায়। এই সুতাগুলোতে গ্লাইসিন অণু শিকলে পরপর ৮ থেকে ৯ বার করে থাকে। ফলে এই সুতাগুলো টেনে শতকরা ৩০ ভাগ পর্যন্ত লম্বা করলেও ছেঁড়ে না। ইস্পাতের তারকেও টেনে এত দূর পর্যন্ত লম্বা করা যায় না। তার আগেই ইস্পাতের তার ছিঁড়ে যায়।

মাকড়সার জালের সুতা ইস্পাতের তারের চেয়েও শক্ত ও মজবুত, তা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। কোন সুতা কত শক্ত, তা হিসাব করার পদ্ধতি হলো, সেটা কী পরিমাণ চাপ সহ্য করতে পারে, তার ওপর। এই চাপ হলো প্রতি একক ক্ষেত্রফলের ওপর কী পরিমাণ বল প্রয়োগ করা হয়, তার পরিমাণ। যে সুতা যত বেশি চাপ সহ্য করতে পারে, সেই সুতা তত শক্ত। সবচেয়ে শক্ত ইস্পাতের তার দুই হাজার মেগা প্যাসকেল চাপ সহ্য করতে পারে। এর বেশি হলে ইস্পাতের তার ছিঁড়ে যায়। মাকড়সার জালের সুতাও এ রকম বা এর চেয়ে বেশি চাপ সহ্য করতে পারে। ইস্পাত ও মাকড়সার জালের তুলনা করতে হলে আমাদের আরও কিছু ধর্মের তুলনা করতে হবে। ইস্পাতের ঘনত্ব মাকড়সার জালের ঘনত্বের চেয়ে অনেক বেশি। এক বর্গমিলিমিটার প্রস্থচ্ছেদবিশিষ্ট এক মিটার লম্বা স্টিলের তারের ভর প্রায় ৮ গ্রাম। অথচ একই প্রস্থচ্ছেদ ও এক মিটার লম্বা মাকড়সার জালের সুতার ভর মাত্র ১ দশমিক ৩ গ্রাম। ৮ গ্রাম ভরের এক মিটার লম্বা একটি স্টিলের তার ২ হাজার নিউটন পর্যন্ত বল সহ্য করতে পারে। তার বেশি হলে ছিঁড়ে যায়। সেই একই পরিমাণ বল সহ্য করতে পারে মাত্র ১ দশমিক ৩ গ্রাম ভরের মাকড়সার জালের সুতা। এখন যদি ৮ গ্রাম ভরের মাকড়সার জাল নেওয়া হয়, সেই সুতা ১২ হাজার নিউটন, অর্থাৎ ইস্পাতের তারের ছয় গুণ বল সহ্য করতে পারে।

মাকড়সার জালের চেয়েও বেশি শক্ত সুতা আছে। যেমন কার্বন ফাইবার প্রায় চার হাজার মেগা প্যাসকেল চাপ সহ্য করতে পারে। কিন্তু কার্বন ফাইবার শক্ত হলেও তেমন ঘাতসহ নয় বা মজবুত নয়। মজবুত বা টাফনেস মাপা হয় কীভাবে? টাফনেস হলো প্রতি একক ভরে কী পরিমাণ শক্তি শোষণ করেও টিকে থাকতে পারে। ইস্পাতের তার প্রতি কিলোগ্রামে ৪ হাজার জুলশক্তি শোষণ করেও টিকে থাকে থাকতে পারে। কার্বন ফাইবার প্রতি কিলোগ্রামে ৪০ হাজার জুলশক্তি শোষণ করে টিকে থাকতে পারে। কিন্তু মাকড়সার জাল প্রতি কিলোগ্রামে প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার জুলশক্তি শোষণ করেও টিকে থাকতে পারে।

পরীক্ষা করে দেখা গেছে, মাকড়সার জাল অনেক উচ্চ তাপমাত্রা (১৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) এবং অনেক নিম্ন তাপমাত্রা (-৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) সহ্য করতে পারে। বিজ্ঞানীরা আরও পরীক্ষা করে দেখেছেন যে বিভিন্ন আকৃতির জালে বিভিন্ন ধরনের শব্দ-তরঙ্গ সৃষ্টি হয়। অতিসম্প্রতি তাইওয়ানের বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন যে মাকড়সার জালের উপাদান ব্যবহার করে জৈবকোষীয় লেন্স তৈরি করা সম্ভব। জার্নাল অব অ্যাপ্লাইড ফিজিক্সে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে ট্যামক্যাং বিশ্ববিদ্যালয় ও ইয়াং-মিং বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা মাকড়সার জালের উপাদান থেকে লেন্স তৈরি করেছেন প্রথমে। তারপর তাতে বিশেষ ধরনের লেজার প্রয়োগ করে দেখেছেন, এই লেন্স অত্যন্ত উচ্চ রেজল্যুশনের ইমেজ বা ছবি তৈরি করতে সক্ষম। অদূর ভবিষ্যতে বিজ্ঞানের অনেক শাখায় মেকানিক্যাল ইমেজিংয়ের পরিবর্তে বায়োলজিক্যাল ইমেজিং ব্যবহার করা হবে। মাকড়সার জাল থেকে তৈরি লেন্স সেখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে বলে আশা করা যায়। বোঝাই যাচ্ছে, মাকড়সার জাল দেখতে নরম মনে হলেও আসলে ইস্পাতের চেয়ে মজবুত, বৈজ্ঞানিকভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস।

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক, আরএমআইটি, মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া