সবাই তো রাজনৈতিক নেতাকর্মী, সাধারণ মানুষ কোথায়

0
4K

‘বঙ্গমাতা’ কবিতার শেষ দুটি পঙ্‌ক্তিতে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী,/ রেখেছ বাঙালি করে—মানুষ কর নি।’  পরবর্তীকালে ক্ষুদিরাম বসু, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুসহ অসংখ্য বাঙালির বীরত্বে ভারত স্বাধীনতা অর্জন করে কবিগুরুর অভিযোগ ভুল প্রমাণ করেন। আর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধারা অসীম সাহসিকতায় সুসজ্জিত পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পরাজিত করে। বাঙালি দ্বিতীয়বারের মতো কবিগুরুর কথাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে। স্বাধীন দেশের মাটিতে পা রেখে বঙ্গবন্ধু তাই বলেছিলেন, ‘কবিগুরু, তোমার কথা মিথ্যে হয়েছে, আমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে।’

সত্যিই তা-ই, ১৯৭১ সালে আমরা মানুষ হয়ে উঠতে পেরেছিলাম বলেই এত বড় বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করতে পেরেছিলাম। কিন্তু সেই মর্যাদা আমরা বেশি দিন ধরে রাখতে পারিনি। তাই ‘চাটার দল’ যখন সবকিছু চেটে খেয়ে ও বিদেশে সম্পদ পাচার করে দেশকে নিঃস্ব করে দিচ্ছিল, তখন বঙ্গবন্ধু আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘মাঝে মাঝে আমরা অমানুষ হয়ে যাই।’

আমাদের মানুষ করার প্রত্যয়ে তাই তিনি উচ্চারণ করেছিলেন, ‘মনে রেখো, মুখে হাসি বুকে বল তেজে ভরা মন, মানুষ হইতে হবে মানুষ যখন।’ কিন্তু এত দিনে আমরা কি আসলে মানুষ হয়ে উঠতে পেরেছি?

আমরা শিক্ষিত হয়েছি, সম্পদশালী হয়েছি, বড় বড় দালানকোটা তৈরি করেছি, সড়ক পাকা করেছি, বড় বড় সেতু নির্মাণ করেছি, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নে উড়ালসেতু ও মেট্রোরেল সংযোজিত করেছি, কিন্তু মানবীয় গুণাবলির বিকাশের মাধ্যমে স্বভাব-চরিত্র, চিন্তা-চেতনা ও ধ্যানধারণার পরিবর্তন করে কতটুকু মানুষ হয়ে উঠতে পেরেছি? সারা দেশ বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু অন্যদিকে মানুষের মনও ভরে উঠেছে কুটিলতা, সংকীর্ণতা, স্বার্থপরতা, রেষারেষি ও অসহিষ্ণুতায়। সমাজ আজ বিষিয়ে উঠেছে। আজ সৎ লোকদের সমাজে স্থান নেই, জ্ঞানীদের কদর নেই, কর্মনিষ্ঠার মূল্য নেই, যোগ্য লোকের ঠাঁই নেই। ঘরে-বাইরে, পথেঘটে, যানবাহনে, অফিস-আদালতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মা-বোনের ইজ্জতের নিরাপত্তা নেই। চাটুকার, দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর-সুদখোর, চোরাকারবারিদের আজ সমাজ ও রাষ্ট্রে সর্বত্র জয়জয়কার। সর্বত্র প্রতারক, ঠকবাজ আর দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে শৃঙ্খলা কি দিন দিন ভেঙে পড়ছে না?

সুস্থ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য কোনো দেশে এমন একটি সাধারণ জনগোষ্ঠী থাকা বাঞ্ছনীয়, যারা কোনো রাজনৈতিক দলের একনিষ্ঠ কর্মী হবে না। আর এই সাধারণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা যত বেশি হবে, ততই সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠব। কিন্তু আমাদের দেশে এখন আর কোনো সাধারণ মানুষ নেই। ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যনির্বিশেষে সবাই এখন কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের একনিষ্ঠ কর্মী বা নেতা।

রাজনীতি আজ দুর্বৃত্তায়নের কবলে পড়ে চরমভাবে কলুষিত। জাতির মেরুদণ্ডতুল্য শিক্ষকেরা আজ অর্থ ও ক্ষমতার লালসা এবং রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নে নীতিনৈতিকতা সম্পূর্ণ জলাঞ্জলি দিয়েছেন। ছাত্ররাজনীতির বিষবাষ্পে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়েছে। বিচারব্যবস্থা আস্থা হারিয়েছে। চিকিৎসাব্যবস্থায়ও চরম আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়েছে। আমলাতন্ত্রে অযোগ্যতা ও গতানুগতিকতা ভর করেছে। তবে এসবের বাইরে এসে প্রতি ক্ষেত্রে দু-একজন এখনো আছেন, যাঁরা দেশের সেবা করে যাচ্ছেন। তাঁদের শতকোটি স্যালুট। আজ ব্রিটিশ রাজ নেই, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীও নেই, সামরিক জান্তার স্বৈরশাসনও নেই। তাহলে কাকে দোষ দেব।

একটু গভীরে ভাবলে বোঝা যায়, আমাদের মানুষ করে গড়ে তোলার ছাঁচগুলো অর্থাৎ পরিবার, শিক্ষাব্যবস্থা, সমাজব্যবস্থা, রাজনৈতিক ব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা ও প্রশাসনিক কাঠামো ত্রুটিপূর্ণ। আর এ ত্রুটিপূর্ণ ছাঁচে দূষিত মানুষ তৈরি হচ্ছে। গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, এই ছাঁচগুলো এখন মানবীয় গুণাবলি বিকাশের মাধ্যমে মানুষ হওয়ার শিক্ষা দেয় না। পরিবার, সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে এখন সততা, সরলতা, আদর্শ, সহিষ্ণুতা, পারস্পরিক সম্মান, নারীর প্রতি সম্মান, শ্রদ্ধাবোধ, সহমর্মিতা, শালীনতা, লজ্জাবোধ এবং  মূল্যবোধের শিক্ষার পরিবর্তে চালাকি, পারস্পরিক প্রতিযোগিতা, হিংসা, বিদ্বেষ, রেষারেষি, কুটিলতা, জটিলতা, ধৃষ্টতা, আমিত্ব, বড়ত্ব, স্বার্থপরতা ও অশ্লীলতার শিক্ষা বেশি পাচ্ছে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া অন্য ছাঁচগুলোও যোগ্যতা, কর্মনিষ্ঠা, ন্যায়পরায়ণতা, ন্যায্যতা ও সুশাসনের পরিবর্তে চাটুকারিতা, অন্যায্য ও দুর্বৃত্তায়নের শিক্ষা দিচ্ছে। আর এর মূল কারণ হলো সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের অনুপ্রবেশ। বয়স-শ্রেণি-পেশানির্বিশেষে দেশের বেশির ভাগ মানুষকে দলীয়-লেজুড়বৃত্তিক রাজনৈতিক কর্মী বা রাজনৈতিক নেতা বানানোর অদূরদর্শী প্রয়াস আজ সব সর্বনাশের মূল।

সুস্থ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য কোনো দেশে এমন একটি সাধারণ জনগোষ্ঠী থাকা বাঞ্ছনীয়, যারা কোনো রাজনৈতিক দলের একনিষ্ঠ কর্মী হবে না। আর এই সাধারণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা যত বেশি হবে, ততই সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠব। কিন্তু আমাদের দেশে এখন আর কোনো সাধারণ মানুষ নেই। ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যনির্বিশেষে সবাই এখন কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের একনিষ্ঠ কর্মী বা নেতা। নেতা–কর্মী এত হলে দলের ভেতর শৃঙ্খলা রক্ষা করা যায় না। আবার অন্য দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়ানোও কঠিন। বেশির ভাগ কর্মী বা নেতার মূল আদর্শ রাষ্ট্রীয় সম্পদে ভাগ বসানো। তাই এসব কর্মী বা নেতাকে তুষ্ট করতে ক্ষমতাসীনদের ন্যায়বিচার ও সুশাসন থেকে পিছু হটতে হয়। আজ বাংলাদেশে এরই প্রতিফলন ঘটছে।  

পরিস্থিতি তলানিতে ঠেকেছে। তাই এখনই সময় ঘুরে দাঁড়ানোর। এখন ঘুরে দাঁড়াতে না পারলে দেশে অস্থিরতা আরও বাড়বে। এ কারণে শিক্ষিত, ধনী, গুণী মানুষ দেশ ছাড়বেন। তাই দেশ সম্পদ ও গুণে উজাড় হয়ে অসভ্যদের আবাসস্থলে পরিণত হবে। কিন্তু বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান রক্ষার্থে তা হতে দেওয়া যাবে না। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে শিক্ষাঙ্গনে দলীয়-লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র ও শিক্ষকরাজনীতি বন্ধ করতে হবে। ছাত্রকে ‘ছাত্র’ এবং শিক্ষককে ‘শিক্ষক’ হতে হবে, রাজনৈতিক কর্মী বা নেতা নয়। দ্বিতীয়ত, বহুধারার শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তে মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন একধারার শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হবে। পরিশেষে বিভিন্ন গোষ্ঠী ও পেশাজীবীর মধ্যে দলীয়-লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি বন্ধ করতে হবে।

  • ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Like
12
Buscar
Categorías
Read More
Shopping
implementing Dior vibrant greens into her early press tour outfits
As we move on from our summer favorites during this transitional weather period, editors have...
By Lilliana Haynes 2024-10-23 06:52:31 0 1K
Juegos
Discover Creativity at Monopolygostickers
As a dedicated sticker enthusiast, I’m always on the lookout for fresh designs that can add...
By stickers monopolygo 2024-10-10 04:55:51 0 1K
Home
Comprehensive Rug and Carpet Cleaning by Carpet Pros in Charlotte
Maintaining clean carpets and rugs is essential for a fresh, inviting home, but everyday traffic,...
By Carpet Pros 2024-10-28 05:51:09 0 1K
Shopping
It seems that the Saint Laurent Sale wind is literally blowing in favor
Almost every season, classic caps make their rounds on the heads of showgoers, and their...
By Sunny Curtis 2024-08-22 11:10:40 0 7K
Juegos
游戏女王:YY游戏的魅力与乐趣
在当今的数字时代,YY游戏 yy game...
By Ellen Green 2024-10-03 06:52:14 0 2K