ইটালি - রোমে প্রথম দিন

0
5K
 
রোম-এর জন্য যখন Transavia এর টিকিট book  করলাম তখন সবচেয়ে যেটা ভাল লেগেছিল সেটা হল - যাওয়া আর আসার সময়সূচী। হল্যান্ডের রটারডাম থেকে সকাল ৭:০০ টায় বেরোনো আর ভেনিস থেকে রাত ১০:০০ টায় ওঠা। মানে যাওয়া ও আসার দিন দুটো কেই পূর্ণমাত্রায় পাওয়া। তবে ৭:০০ টায় প্লেন ধরা মানে ভোররাতে বেরোনো তাই রাত ৩:৩০ টেয় ট্যাক্সি বুক করে কিছুটা আশঙ্কায়  ছিলাম বই কি - ঠিক সময় পৌছতে পারব তো? কিন্তু এদেশে সেটা কোনো ব্যাপারই না। তাই ৪:০০ টায় বেরিয়ে আধঘন্টার মধ্যে এয়ারপোর্টে পৌছেও হাতে অজস্র সময়। তারপর মাত্র দু ঘন্টার যাত্রা শেষে পৌছে গেলাম রোমের Flumicino এয়ারপোর্টে। তবে এখান থেকে রোম শহর অনেক দুর। Terminal থেকে হাঁটতে-হাঁটতে স্টেশনে পৌছনোও নেহাত কম রাস্তা নয়। পরিষ্কার করে হলুদ সাইনে দিকনির্দেশ করা আছে - তাই ভাষার দুরত্ব থাকলেও চিন্তার কারণ নেই।  লিওনার্দো এক্সপ্রেসে ১৪ ইউরো করে দুজনের টিকিট কেটে উঠে পড়া গেল। পুরো ইটালিতে ১১ বছরের কম বয়েসী বাচ্ছার পাবলিক ট্রান্সপোর্টেশনে টিকিট লাগে না - তাই শ্রীযুক্ত রীতংকর পাল "ব্যাম্বিনো" নিখরচায় ইটালি চষে ফেললেন।  বড়দের জন্য ১০০ মিনিটের মেট্রো টিকিট ১.৫০ আর ২৪ ঘন্টার টিকিটের খরচ পড়ে ৭ ইউরো - আনলিমিটেড যেকোনো লাইনে। রোমের মেট্রো কিছুটা অপরিচ্ছন্ন বটে তবে ৩-৪ মিনিট অন্তর গাড়ী আর শহরের সমস্ত দ্রষ্টব্যের কাছেই স্টেশন। এয়ারপোর্টে থেকে ট্রেনে ৪০ মিনিটের মধ্যে রোমা টার্মিনি স্টেশন আর সেখান থেকে ৫ মিনিটের হাঁটা দুরত্বে হোটেল ফিয়ামা পৌছতে বেশী কষ্ট করতে হয়নি। টার্মিনি স্টেশনের কাছাকাছি থাকার সুবিধে মেট্রো A, B লাইন এবং অগুন্তি বাস।  ইউরোপে সর্বত্রই ডবল বেড রুম নিয়েছি - আট বছরের ছেলের জন্য আলাদা করে চার্জ দিতে হয়নি। এক্সট্রা বালিস বা লেপ চাইলেই পাওয়া যায়। যাইহোক বাড়ী থেকে নিয়ে যাওয়া খাবার খেয়ে অল্প রেস্ট নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ইটালিতে নিজের ব্যাগ, ক্যামেরা সাবধান - প্রথম দিন মেট্রো স্টেশনে এস্কালেটরে নামবার সময় খেয়াল করেছিলাম পেছনের মহিলা আমার ব্যাকপ্যাকের চেন খুলছেন - ঘুরে দাঁড়াতে নির্লিপ্ত মুখ করে সরে গেলেন। আপাতদৃষ্টিতে কম সন্দেহভাজন মানুষই বিপজ্জনক।
প্রথম দিন - রোমকে গ্রেগরি পেক আর অড্রে হেপবার্ন জনপ্রিয় করে গেছেন রোমান হলিডের দৌলতে। মেট্রো ধরে স্পাগ্না স্টেশনে নেমে স্প্যানিস স্টেপ। পিয়াজ্জা ডি স্পাগ্না -র ফোয়ারা থেকে সোজা সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরে ট্রিনিটা দেই মন্টি চার্চের দিকে। ১৭২৩-২৫ এ ফরাসি ডিপ্লোম্যাট বুরবঁ -স্প্যানিস এমব্যাসির অর্থানুকুল্যে তৈরি করে দেন স্বর্গের। সিঁড়ির নিচের ধাপে ও স্কোয়ারে লাইভ পারফর্মান্স হয়, তবে এখন রেনোভেশনের জন্য বন্ধ। সিঁড়ির ধাপে ধাপে মার্ক করা কোথায় বিখ্যাত হলিউড স্টারের (সোফিয়া লরেন, জিনা লোলো ব্রিজিদা) দাঁড়িয়ে ছবি তুলে গেছেন। ওপরে উঠে রোম শহরের ভিউ - এই প্রথম চর্মচক্ষুতে দেখলাম। এককালে মিশর, রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। সেখান থেকে আনা একটা ওবেলিক্স এখানে দাঁড়িয়ে। এমন ওবেলিক্স রোমের আরো অনেক চত্বরে (পিয়াজ্জা) দেখতে পেয়েছি। টিলার ওপরে চার্চ  - খুব বড়ো নয় তবে প্রাচীন (১৪৯৪)। কাঠের বেঞ্চ আর হাই অল্টার-এর মাঝে রেলিং এর বেড়াজাল। সিলিং ও পাশের ছোট অল্টার-এ পুরনো পেন্টিং দেখলাম। আর রয়েছে মার্বেলে তৈরি যীশুর মৃত্যু বা পিয়াতা।
 
এখান থেকে বেশ কিছুটা হেঁটে পিয়াজ্জা ডেল পোপোলো - বা পিপলস স্কোয়ার। এক সময় এখানে ফাঁসীও হয়েছে। চত্বরের একদিকে রোমের উত্তরের দরজা - শহরে ঢুকে মানুষ এখান থেকে প্রথম রোম দেখত। চত্বরের মাঝখানে ওবেলিক্স - দ্বিতীয় রামসেস এর আমলের - ওপরে সূক্ষ হায়ারোগ্লিফিক্সের inscriptionচত্বরের দুদিকে রোমান বীর আর জ্ঞানী মানুষের পাথরের মূর্তি। চতুর্থ দিকে চার্চ সান্তা মারিয়া দেল পোপোলো।  এবার ভিয়া দেল করসো ধরে হাঁটা - গন্তব্য প্যান্থিয়ন। তবে রোমের পথে পথে মনিমুক্ত ছড়িয়ে আছে - যেমন পুরনো ব্যারোক চার্চ, ফোয়ারা আবার অজস্র যুদ্ধের কাহিনী নিয়ে রোমান ওবেলিক্স পিয়াজ্জা কোলোনা বা দি মন্টেসিতোরিও। প্যান্থিয়নের আগে পথ ভুলেও কয়েকটা সৌধ দেখেছি - যেটা কোনোটা প্রিন্সেপ ঘাট কোনোটা রাজেন মল্লিকের বাড়ীর কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। প্যান্থিয়নে যখন পৌছলাম তখন ক্লান্তি চরমে উঠেছে, তবে এই সুপ্রাচীন অনবদ্য সৌধ দেখে মন ভরে গেল। ভিক্টোরিয়া মেমরিয়ালের মাঝের হল ঘরের মাপে ঘর - ডোমের ঠিক মাথার মাঝে একটা গোলাকার গর্তের মধ্যে দিয়ে সূর্যের আলো ভেতরে এসে পড়েছে।  ডোমের জ্যামিতিক কাজ ২০০০ বছর ধরে অবিকৃত - তেমনি সুন্দর আর রঙ্গীন মেঝের মার্বেল। আগে সুপ্রাচীন (এনসিয়েন্ট) রোমে দেবতার মন্দির হিসেবে ব্যবহার হলেও পরে ক্রিশ্চিয়ানরা চার্চে পরিবর্তন করে ফেলে। রেনেসাঁ যুগে সমাধি দেওয়ার জন্যও ব্যবহার করা হয়েছে - যেমন  শীল্পি রাফায়েল। বাইরের পোর্টিকোতে মোটা গ্রানাইটের থাম। প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে প্যান্থিয়ন দেখে বাইরে বেরিয়ে ক্ষিদে আর ক্লান্তি কাটাতে সামনের ফোয়ারার ধারে বসে বাড়ী থেকে আনা চিলিচিকেন আর চাউ দিয়ে পেট ভর্তি করে খাওয়া। দেহের ব্যাটারি রিচার্জ করে এগোলাম পিয়াজ্জা নাভোনা'র দিকে। চত্বরের মাঝে ওবেলিক্স আর ফোয়ারার মাঝখানে শ্বেত পাথরের সৌধ - Fountain of the Four Rivers - চারকোনে চারজন মানুষ চার মহাদেশের নদী সভ্যতার প্রতিভু। এদের মধ্যে অবশ্যই একটা আমাদের গঙ্গা (এশিয়া)। তাদের মাঝে সিংহ আর ঘোড়ার জল খাওয়া। পরের গন্তব্য Fountain of Trevi. এর সৌন্দর্য্য বিস্ময়কর, অপূর্ব। ফোয়ারার পাশে তিনটে স্তরে মানুষ বসে হাঁ করে সেই সৌন্দর্য্য দেখছে, তারপর উল্টোমুখে কাঁধের ওপর দিয়ে জলে পয়সা ছুঁড়ে দিয়ে বলছে আবার যেন এখানে ফিরে আসি। একটা প্রবাদও আছে তার সঙ্গে - প্রাচীন রোমে খুব জলকষ্ট ছিল। বাচ্চা একটি মেয়ে ১৩ কিলোমিটার দুরে মিষ্টি জলের উতস খুঁজে দিলে - অ্যাকোয়াডাক্টের মাধ্যমে সেই জল এখানে এনে ফেলা হয় আর সেই ছোট মেয়ের কথা মাথায় রেখে নাম দেওয়া হয় - অ্যাকোয়া ভার্গো। ইচ্ছে ছিল আর একবার এসে রাতের ট্রেভির সৌন্দর্য্য দেখে যাব। সে আর এযাত্রায় হলো না - যাইহোক এর টানে আবার রোম আসার ইচ্ছে রইল।
দ্বিতীয় দফায় আবার বেরোনো গেল বিকেল বেলায়। রোমে এসে এখনো কলোসিয়ামের মুখদর্শন করিনি ভাবতেও কি রকম লাগে। আর এই মে মাসে রাত ৯:০০টা পর্যন্ত দিনের আলো - সুতরাং চিন্তা কি? B-লাইনে কলসিয়াম মাত্র খানতিনেক স্টপেজ। স্টেশনের বাইরে বেরতেই সেই বিশাল স্ট্রাকচার - যা ছোটবেলা থেকে ইতিহাস বই এর পাতায় দেখে আসছি। তবে আজ ভেতরে ঢুকবো না, বাইরে থেকে দেখে রোমান ফোরামের রাস্তায় কিছুটা এগিয়ে পাহাড়ের ওপর রোমে ক্রিশ্চিয়ানদের প্রথম যুগের চার্চ (Palantine Hill) দেখে এগোলাম ইমানুয়েল ভিত্তোরিয়ানোর দিকে। আকারের জন্য একে টাইপরাইটার বলে। তখন শেষ বিকালের সূর্যাস্তের আলো সোনার মত সেই সৌধের ওপর পড়ছে। সময়টাকে স্মরনীয় করে রাখতে কিছুক্ষন বসে বসে সেই দৃশ্য দেখলাম। পেছনে প্রাচীন রোমের বাজার আর মিনার্ভা মন্দিরের ভগ্নাবশেষ আর সামনে সংঘবদ্ধ ইটালি'র প্রথম সম্রাট ভিক্টর ইমানুয়েল'র সম্মানে তৈরি সৌধ। টাইপরাইটারের দাঁড়ি গুলো ১৬ টা ইটালিয় শহরের প্রতিভু। মাথার ওপর ঘোড়ায় চড়া Unity ও Liberty'র প্রতীক। হেঁটে আবার ফিরে এলাম কলোসিয়াম চত্বরে। সন্ধের আলো একটা একটা করে জ্বলতে শুরু করেছে। হাতে ক্যামেরা নিয়ে ট্যুরিস্টরা অপেক্ষা করছে আর আছে স্বভাষী বাংলাদেশী হকার রা। অল্প পয়সার সেল্ফি স্টিক, LED টর্চ, রুমাল, স্কার্ফ - ট্যুরিস্টরা দর দাম করে কিনছেও। কিন্তু এই বেচে ক'পয়সা হয়? দেশ থেকে এতদূর এসে - পেটের ভাত জোটানোর জন্য উদয়াস্ত পরিশ্রম - সঞ্চয় তো অনেক দূরের কথা। পরে খবর নিয়ে জেনেছিলাম ইটালি বেআইনি অভিবাসী দের স্বর্গ। যুদ্ধবিধ্বস্ত মধ্যএশিয়া, আফ্রিকা থেকে দলে দলে মানুষ এখানে আসছে - তাদের সঙ্গে বিভিন্ন পথে রুটিরুজির টানে ঢুকছে দরিদ্র তৃতীয় বিশ্বের লোকও। ইটালির কলে কারখনায় অল্প পয়সার চাকরি - দেশ থেকে পরিবারকে এখানে আনবার সামর্থ্যও থাকেনা। ইটালিয়ান শ্রমজীবি মহিলা'রাও খুব কর্মপটু, সুতরাং একটু ভুলচুক হলে কাজ হারাতেও দেরি হবেনা।
 
--প্রদীপ্ত প্রতিম পাল
Like
1
Sponsor
Căutare
Categorii
Citeste mai mult
Fitness
Boost Your Body’s Performance with Titan Edge XL Gummies Buy Bottles
Elevate Your Performance with Titan Edge XL Gummies: The Ultimate Energy Boost In the fast-paced...
By Titan Edge XL Gummies 2025-01-15 09:34:33 0 51
Shopping
How To Reuse A 13X4 Lace Front Wig
It is known that 13x4 Lace Wig are a good investment. Women want to adorn themselves...
By Mslynnhair Mslynnhair 2022-11-28 06:31:29 0 4K
Shopping
Dior Shoes he decided to show them for the first time
Apart from any beachside activities, packing and planning for balmy evenings out is equally...
By Vienna Bauer 2024-05-28 06:55:11 0 5K
Networking
How to Place Handicap Bets in Football
How to Place Handicap Bets in Football Handicap betting, commonly known as Asian Handicap (AH),...
By Phoco Phocohanoi2 2024-11-19 06:56:18 0 2K
Alte
What are the importance of Greenville car accident attorney
Introduction to Car Accidents in Greenville Car accidents are a common occurrence , with...
By Webkey Digital 2024-12-27 07:01:33 0 543