ও মানুষ, কীসে তোমাকে তোমার দয়াময় প্রতিপালকের কাছ থেকে দূরে নিয়ে গেলো? — আল-ইনফিত্বার

0
5χλμ.

যখন আকাশ ছিঁড়ে বিদীর্ণ করা হবে, তারাগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলা হবে, সাগরে বিস্ফোরণ ঘটানো হবে, কবরগুলো ঝেড়ে বের করে ফেলা হবে… প্রত্যেকে জেনে যাবে সে কী করেছে এবং কী ছেড়ে এসেছে। —আল-ইনফিতার ১-৫

 

অকল্পনীয় লম্বা সময় ধরে আকাশ এই সৃষ্টিজগতকে আগলে রেখেছে। একদিন তাকে ছিঁড়ে বিদীর্ণ করে ফেলা হবে। এর মধ্যে খুলে দেওয়া হবে অতিজাগতিক দরজা, যেগুলো দিয়ে অন্য জগত থেকে অজানা সত্ত্বারা এই জগতে চলে আসবে। সৃষ্টিজগতের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্তপূর্ণ দিন পরিচালনা করার জন্য তারা অপেক্ষা করছিল। সেদিন নির্দেশ পাওয়া মাত্র তারা আকাশ ছিঁড়ে ভেদ করে চলে এসে শুরু করে দেবে এক মহাপ্রলয়ের প্রস্তুতি। ‘ইনফিত্বার’  ٱنفطار এসেছে ‘ফাত্বর’ থেকে, যার অর্থ বিদীর্ণ হয়ে যাওয়া, কোনো কিছু ছিঁড়ে ফেটে বের হয়ে যাওয়া। যেমন, মাড়ি ভেদ করে দাঁত বের হয়ে যাওয়া হচ্ছে ফাত্বর। এই আয়াতে যেন বলা হচ্ছে যে, একদিন আকাশ ছিঁড়ে কিছু বের হয়ে আসবে।[১৪]

পুরো আকাশ এমনভাবে বিদীর্ণ করে ফেলা হবে যে, নক্ষত্রগুলো সব বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাবে। আরবিতে كواكب ‘কাওয়াকিব’ অর্থ সেই উজ্জ্বল স্থির নক্ষত্রগুলো, যেগুলো ব্যবহার করে মানুষ রাতের আধারে, মরুভূমিতে, সমুদ্রে পথ খুঁজে পায়।[১] সেদিন সেই নক্ষত্রগুলো বিক্ষিপ্ত হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাবে, মানুষ হারিয়ে ফেলবে দিক নির্দেশনা। আর কোনো প্রয়োজন নেই দিক-নির্দেশনার। এই জগতের সময় শেষ। সকল জাগতিক ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ এখন বন্ধ।

তারপর সমুদ্রে বিস্ফোরণ ঘটানো হবে। ঢাকনা দেওয়া পাত্রে পানি অতিরিক্ত চাপে ফুটানোর ফলে একসময় তা প্রচণ্ড বিস্ফোরণে যেমন ছিটকে পড়ে দিকবিদিক, তেমনি সমুদ্রগুলো বিস্ফোরিত হয়ে যাবে। সমুদ্রের লক্ষ-কোটি টন পানি বিস্ফোরিত করে দেওয়ার জন্য কী অকল্পনীয় পরিমাণ তাপ দরকার, তা আমরা চিন্তাও করতে পারি না। কিন্তু আল্লাহর تعالى জন্য তা খুবই সহজ। পৃথিবীর অভ্যন্তরভাগ এক প্রকাণ্ড উত্তপ্ত লাভার চুল্লি। কিছু বড় ভূমিকম্প হয়ে সেই লাভা বের হয়ে আসলেই সমুদ্রের পানিগুলো প্রচণ্ড উত্তাপে বিস্ফোরিত হয়ে যাবে। সমুদ্রের বিশালত্ব এবং গভীরতা দেখে আমরা যতই বিস্মিত হই না কেন, পৃথিবীর উপরের স্তরটি আসলে একটি পাতলা খোলস ছাড়া আর কিছু নয়। এর ভেতরটা বিশাল। সেখানে সাংঘাতিক সব ঘটনা ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত।

এই আয়াতগুলোর মধ্য দিয়ে আল্লাহ تعالى মানুষকে তার অবস্থান কোথায় জানিয়ে দেন। বিশাল পৃথিবী, প্রকাণ্ড সব সমুদ্র, উপরে কল্পনাতীত বড় সৃষ্টিজগত—যাদেরকে আমরা এত সমীহ করি, তাদেরকেই আল্লাহ تعالى টেনে ছিঁড়ে ফেলবেন, বিস্ফোরিত করে দেবেন। তাহলে মানুষের মতো নগণ্য সৃষ্টি কীভাবে এই প্রচণ্ড ক্ষমতাকে অবমাননা করার ধৃষ্টতা দেখায়?

এরপর কবরগুলোকে কীভাবে খালি করে ফেলা হবে, তার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। অনেক সময় আমরা বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার সময় ব্যাগ গুছানোর পর দেখি যে, কোথাও চাবি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তখন আবার ব্যাগের ভেতরের সবকিছু বের করে, উল্টে-পাল্টে ঝেড়ে পুছে দেখি ব্যাগে চাবি আছে কিনা। এই হচ্ছে আরবিতে بعثرت ‘বু‘ছিরাত’। কবরগুলোকে এভাবে একদম ঝেড়ে-পুছে পরিষ্কার করে ফেলা হবে।

তারপর কবরের বাসিন্দারা উঠে দাঁড়াবে এবং তারা জেনে যাবে সামনে কী হতে যাচ্ছে।

প্রত্যেকে জেনে যাবে সে কী করেছে এবং কী ছেড়ে এসেছে

আমাদের প্রতিটি ভালো এবং খারাপ কাজ সেদিন আমাদেরকে দেখানো হবে, কিছুই বাদ দেওয়া হবে না।

যখন হিসেবের খাতা এনে রাখা হবে, তুমি দেখবে অপরাধীরা ভয় পেয়ে গেছে, সেখানে কী লেখা আছে দেখে। তারা হায় হায় করে উঠবে, “কী সর্বনাশ! এটা কী বই! এখানে দেখি খুঁটিনাটি সবকিছুই আছে! কিছুই বাদ নেই!” তারা যা কিছু করে এসেছে, তার সব সেখানে উপস্থিত পাবে। তোমার রব বিন্দুমাত্র অন্যায় করেন না।  —আল-কাহফ ৪৯

একইভাবে যে ভালো কাজগুলো করার সুযোগ পেয়েছিলাম, কিন্তু করিনি, সেটাও আমরা দেখতে পারবো।[৪][১১][৭] আমরা অসহায়ের মতো তাকিয়ে দেখতে থাকবো—জীবনে কতবার আমাদের কাছে মানুষ সাহায্য চাইতে এসেছিল, কিন্তু আমরা ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। কতবার অন্যায় দেখে সংশোধন করার বা অন্তত প্রতিবাদ করার সুযোগ পেয়েছিলাম, কিন্তু সুবিধাবাদী মেরুদণ্ডহীনের মত আপোষ করেছিলাম। কতবার নিজেকে সংশোধন করার জন্য চোখের সামনে সুযোগ উপস্থিত করা হয়েছিল, কিন্তু ব্যস্ততা-বিনোদনের অজুহাত দেখিয়ে সেই সুযোগগুলো হাতছাড়া করেছিলাম।

তখন শুধুই আফসোস করবো—

যখন এদের কারো কাছে মৃত্যু চলে আসে, তখন এরা আফসোস করে , “ও রব! আমাকে ফেরত যেতে দিন! আমি যে ভালো কাজগুলো ছেড়ে এসেছি, সেগুলো যেন কিছু করে আসতে পারি।” —আল-মু‘মিনুন ৯৯-১০০ না, বরং সাবধান! যেদিন পৃথিবীকে পিষে চূর্ণ বিচূর্ণ করা হবে এবং তোমার প্রতিপালক আসবেন সারি সারি ফেরেশতাদের নিয়ে। সেদিন জাহান্নামকে সামনে নিয়ে আসা হবে, আর মানুষের সব মনে পড়তে থাকবে। কিন্তু সেদিন মনে করে আর কী লাভ হবে? তারা হাহাকার করতে থাকবে, “হায়! এই জীবনের জন্য যদি কিছু করে রাখতাম!” সেদিন তিনি এমন শাস্তি দেবেন, যা কেউ দিতে পারে না। এমনভাবে আটকাবেন, যেভাবে কেউ আটকাতে পারে না। — আল-ফাজর  ২১-২৬

একইসাথে আমরা দেখতে পারবো কতবার অন্যায় করার সুযোগ পেয়েও করিনি।[৪][১৪][৭] কতবার বন্ধুবান্ধবরা নোংরা কাজে ডেকেছিল, ফালতু সময় নষ্ট করতে চেয়েছিল, কিন্তু ওদেরকে সঙ্গ দেইনি। কতবার আত্মীয়রা ইসলাম-বিরোধী কাজে-ভরা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করেছিল, সুস্বাদু খাবারের লোভ ছিল, কিন্তু যাইনি। কতবার রাতের অন্ধকারে, একাকী ঘরে দরজা বন্ধ করে পশুর মতো নোংরা কাজ করার চিন্তা মাথায় এসেছিল, কিন্তু আল্লাহর تعالى ভয়ে নিজেকে সামলে নিয়েছিলাম। —সবকিছুই সেদিন আমাদেরকে দেখানো হবে।

আরও দেখুন:  বেশি-বেশি পাওয়ার প্রতিযোগিতা তোমাদেরকে ভুলিয়ে দিয়েছে—আত-তাকাছুর

একইসাথে দেখতে পারব আমাদের সেই অবদানগুলো, যেগুলোর কথা আমরা জানতাম না, কিন্তু ঠিকই সেগুলো মানুষের উপকারে এসেছিল।[৪] আমাদের যে সম্পদগুলোকে আমরা পরকালের জীবনের জন্য অগ্রিম করে রেখেছিলাম, সেগুলো সেদিন গিয়ে চোখের সামনে দেখতে পারবো। আর যে সম্পদগুলোকে দুনিয়াতে নষ্ট করে ফেলেছিলাম, পরকালের জন্য রেখে দিতে পারতাম, কিন্তু দেইনি, সেগুলোও দেখতে পারবো।[৪]

ও মানুষ, কীসে তোমাকে তোমার দয়াময় প্রতিপালকের কাছ থেকে দূরে নিয়ে গেলো? যিনি তোমাকে সৃষ্টি করে যথাযথ আকৃতি দিয়েছেন। তারপর তোমাকে ভারসাম্য দিয়েছেন। তিনি যেভাবে চেয়েছেন, সেভাবেই তোমাকে তৈরি করেছেন। —আল-ইনফিত্বার ৬-৮

ও মানুষ, কীসে তোমাকে তোমার দয়াময় প্রতিপালকের কাছ থেকে দূরে নিয়ে গেলো?

আজকে যদি আপনাকে ডাক্তার বলে, “আপনার রক্তে ক্যান্সার ধরা পড়েছে এবং আপনি আর কয়েক সপ্তাহের মধ্যে মারা যাবেন, সিঙ্গাপুরে গিয়েও লাভ হবে না” —আপনি তখন কী করবেন? আপনি কি তখন কাঁথা জড়িয়ে টিভির সামনে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফালতু তারকা শো, টক শো, সিরিয়াল দেখবেন? পরদিন অফিসে গিয়ে কলিগদের সাথে শেষ বারের মতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা মারবেন? ছেলেমেয়েকে শেষ বারের মতো একটু খুশি করার জন্য ভিডিও গেম কিনে দিবেন, যেখানে তারা রামদা-ছুরি নিয়ে একপাল অর্ধ মৃত, রক্তাক্ত জম্বিকে মেরে কোনো এক বিকৃত কারণে বড়ই আনন্দ পায়? আপনি কি এই অবস্থায় আপনার মেয়েকে নৃত্য শিল্পী বানাবেন, ছেলেকে ব্যান্ডের দলে যোগ দেওয়াবেন, যেন তারা সেগুলো করে আপনার মৃত্যুর পরে আপনার জন্য ‘অশেষ সওয়াব’ অর্জন করে?

না, আপনি তখন এগুলোর কিছুই করবেন না। অথচ আজকে আপনি ঠিকই সেগুলো করে যাচ্ছেন, এটা ভালো করে জেনে যে: আপনি আজকে হোক, কালকে হোক, একদিন না একদিন মারা যাবেনই। তারপর একসময় আপনাকে আবার জাগিয়ে তোলা হবে। তারপর আপনাকে ধরে নিয়ে বিশ্বজগতের সর্বোচ্চ ক্ষমতাবানের সামনে দাঁড় করানো হবে: আপনার জীবনের প্রতি মুহূর্তের হিসাব দেওয়ার জন্য। সেদিন তাঁর সামনে মাথা নিচু করে আপনি তাঁকে কী বলবেন—সেটা কি ঠিক করে রেখেছেন?

কোনো কারণে আমরা মৃত্যু নিয়ে বেশি চিন্তা করতে চাই না। এরকম চিন্তা মাথায় এলেই আমাদের কেমন যেন অস্বস্তি লাগে। আমরা দ্রুত চিন্তার বিষয় পাল্টে ফেলি। যদি আমাদের কোনো বন্ধু বা আত্মীয় আমাদেরকে এই ব্যাপারটি নিয়ে কিছু বলা শুরু করে, আমরা জলদি তাকে বলি, “কী বলছেন এইসব! এই সব মরা-টরার কথা শুনতে ভালো লাগছে না। বাদ দেন। আসেন অন্য কিছু নিয়ে কথা বলি।”

আমরা কোনো এক অদ্ভুত কারণে নিজেদেরকে একধরনের সেলফ ডিলিউশনে (মতিবিভ্রমে) ডুবিয়ে রাখি যে, আগামি কয়েক সেকেন্ড পরে আমি যে হার্ট অ্যাটাক করে মারা যাব না, বা কালকে আমি যে বাসায় ফেরার পথে অ্যাকসিডেন্ট করে মারা যাব না—এ ব্যাপারে আমি একশ ভাগ নিশ্চিত। আল্লাহর تعالى সাথে আমার একধরনের চুক্তি আছে: তিনি আমাকে সত্তর-আশি বছর বয়স পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখবেনই। তাই জীবনে অনেক সময় আছে ধর্ম-টর্ম করার। এখন আগে যত পারি চাকরি, ব্যবসা, পার্টি করে; মুভি, সিরিয়াল দেখে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা মার্কেটে ঘুরে, লক্ষ টাকা খরচ করে বিদেশে বেড়িয়ে এসে —যত পারি জীবনটা উপভোগ করে নেই। বলা তো যায় না, যদি মরে যাই? তাহলে তো এসব আর করা হবে না।

মৃত্যু নিয়ে কেউ যদি ঠাণ্ডা মাথায় বসে গভীরভাবে চিন্তা করে: মৃত্যুর পরে তার কী হবে? সে কোথায় যাবে? সে কি সত্যিই আল্লাহকে تعالى বোঝাতে পারবে: কেন সে জীবনটা এভাবে পার করেছে? —এগুলো নিয়ে কেউ যদি একটু মনোযোগ দিয়ে, ধিরস্থিরভাবে বসে কিছুক্ষণ চিন্তা করে, তাহলে তার জীবন সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা বদলে যেতে বাধ্য। আজকাল আমরা জীবন শৃঙ্খলায় এত বেশি জড়িয়ে পড়েছি যে, সেগুলো থেকে নিজেকে বের করে এনে, চুপচাপ কিছুক্ষণ একাকী বসে নিজের মৃত্যু সম্পর্কে চিন্তা করার সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছি। যদিও বা মাঝে মধ্যে চিন্তা করতে বসি, তখন আমাদের চিন্তা-ভাবনাগুলো হয়: “আমার স্বামী/স্ত্রীকে কে দেখবে? আমার সন্তানদের কী হবে? আমার বাড়ি, গাড়ি, জমি, ব্যাংকের টাকার ভাগবাটোয়ারা কীভাবে হবে? আমার ব্যবসা কে চালাবে?” —নিজেকে নিয়ে চিন্তা করার সময় নেই। মৃত্যুর পরে আখিরাতে আমার নিজের কী অবস্থা হবে —সেটা নিয়ে চিন্তা না করে বরং আমরা চিন্তা করতে ব্যস্ত: মৃত্যুর পরে দুনিয়াতে বাকি সবার কী অবস্থা হবে।

না ! তোমরা বরং শেষ বিচারকে মিথ্যা বলে বেড়াও। তোমাদের উপর অবশ্যই সংরক্ষক রয়েছে। তারা সম্মানিত লেখকবৃন্দ। তোমরা কী করো, তারা জানে। —আল-ইনফিত্বার ৯-১২

ধরুন, আপনি প্রতিদিন কী করেন, সেটা নিয়ে একটা ‘রিয়েলিটি টিভি শো’ বানানো হচ্ছে। আপনার বাসার সবগুলো রুমে ক্যামেরা বসানো হয়েছে। আপনি ঘুম থেকে ওঠার পর ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত সবসময় আপনার সাথে একজন ক্যামেরাম্যান আপনার দিকে ক্যামেরা তাক করে রেখেছে। আপনি কী বলছেন, কী করছেন, কী খাচ্ছেন, কী দেখছেন, সবকিছু প্রতি মুহূর্তে রেকর্ড করা হচ্ছে। কল্পনা করুন, যদি এরকম কোনো ঘটনা সত্যিই ঘটে তাহলে আপনার মানসিক অবস্থা কী হবে? আপনি প্রতিটা কথা বলার আগে চিন্তা করবেন যে, আপনার কথাগুলো মার্জিত হচ্ছে কি না, আপনার হাঁটার ধরন ঠিক আছে কি না, আপনি উল্টোপাল্টা দিকে তাকালে সেটা আবার রেকর্ড হয়ে গেলো কি না। আপনি টিভিতে যেসব হিন্দি সিরিয়াল, বিজ্ঞাপন, মুভি দেখেন, যেসব গান শুনেন, ইন্টারনেটে যে সব সাইট ঘুরে বেড়ান, সেগুলো ক্যামেরায় রেকর্ড হয়ে গেলে লোকজনের কাছে মান-সন্মান থাকবে কি না। আপনার নিজের প্রতি দায়িত্বশীলতা, সচেতনতা হাজার গুণে বেড়ে যাবে।

সিসি-টিভি ক্যামেরা থেকে আরও বহু গুণ উন্নত প্রযুক্তিতে আমাদের প্রতিটি কাজ রেকর্ড করা হচ্ছে। ক্যামেরায় যান্ত্রিক ত্রুটি হয়, লোডশেডিং হলে বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের উপর যে সংরক্ষকদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তারা মুহূর্তের জন্যও বিরতি নেন না, তারা ত্রুটিবিচ্যুতিহীন। তারা কোনো যন্ত্র নন, তারা এক ধরনের বুদ্ধিমান সত্তা। ক্যামেরা বোঝে না কী হচ্ছে, কিন্তু তারা বোঝেন আমরা কী করছি। তারা যখন আমাদের কাজ রেকর্ড করেন, তারা জেনে বুঝেই তা রেকর্ড করেন।[১৪] তাদের মধ্যে কোনো পক্ষপাত নেই। আমাদের প্রতি তাদের কোনো দুর্বলতা নেই যে, তারা আমাদের কোনো অন্যায় ছেড়ে দেবেন। আমাদের প্রতি তাদের কোনো রাগ-ক্ষোভ-অভিযোগও নেই যে, তারা আমাদের কোনো ভালো কাজকে গোপন করে ফেলবেন —তারা সম্মানিত লেখক। কিয়ামতের দিন তারা যখন তাদের রেকর্ড জমা দেবেন, তখন আমরা তাদের প্রতি কোনো ধরনের অভিযোগ করে তাদের কাজের যথাযথতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবো না।

“তোমরা কী করো, তারা জানে” — একজন মুসলিমের জন্য এর চেয়ে ভয়ের কিছু নেই। আমরা অনেক সময় এমন কিছু কাজ করি, যা অন্য কেউ দেখে ফেললে, অথবা মানুষের কাছে প্রকাশ হয়ে গেলে আর মানুষকে মুখ দেখাতে পারবো না। সারা জীবন মাথা নিচু করে অপমানিত হয়ে জীবন পার করতে হবে। এত কষ্ট করে অর্জন করা মান-সম্মান, মানুষের ভালবাসা সব মুহূর্তের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। অনেক সম্মানিত মানুষ আছেন যাদেরকে আমরা শ্রদ্ধা করি, অনুসরণ করি। অথচ তাদেরই জীবনে দেখা যায় তারা এমন কিছু করেছেন, যা জানতে পারলে আমরাই তাদের মুখে থুথু মারব। এরকম একটা নোংরা মানুষকে কীভাবে আমরা এতদিন সম্মান করেছি, তা ভেবে নিজেকে ধিক্কার দেবো। প্রতিটি মানুষের জীবনেই এরকম লজ্জার ঘটনা আছে, যা সে সারাজীবন মানুষের কাছে গোপন রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে। মানুষের কাছে গোপন রাখতে পারলেও ‘কিরামান কাতিবিন’ — সম্মানিত লেখকদের কাছে গোপন করতে পারবে না। একদিন আল্লাহর تعالى আদালতে এই লেখকরা আমাদেরকে নিয়ে লেখা কিতাব জমা দেবেন। সেদিন আল্লাহর تعالى সামনে একা দাঁড়িয়ে আমরা এই দুনিয়ায় করা প্রতিটি কাজ এক এক করে দেখতে থাকবো।

পুণ্যবানরা থাকবে অনাবিল সুখ-শান্তিতে। আর চরম অপরাধীরা থাকবে লেলিহান শিখায়। বিচারের দিন তারা সেখানে প্রবেশ করবে।  সেখান থেকে কখনোই তারা রেহাই পাবে না। কে আছে তোমাকে বোঝাবে যে, সেই বিচার দিন কী হতে যাচ্ছে? আবার বলছি, কে আছে তোমাকে বোঝাবে যে, সেই বিচার দিন কী হতে যাচ্ছে? সে এমন এক দিন যেদিন কেউ কারো জন্য কিছুই করতে পারবে না। সেদিন সব কর্তৃত্ব হবে শুধু আল্লাহর। —আল-ইনফিত্বার ১৩-১৯

“সে এমন এক দিন যেদিন কেউ কারো জন্য কিছুই করতে পারবে না”—যেই আত্মীয়ের সাথে সম্পর্ক ঠিক রাখার জন্য তার বিয়ের অনুষ্ঠানে অর্ধ নগ্ন হয়ে গেলাম, যেই বন্ধুর সাথে সম্পর্ক ঠিক রাখার জন্য তার বাচ্চার বার্থডে পার্টিতে গিয়ে ছেলে-মেয়ে মাখামাখি করে নাচ-গান করলাম, যেই প্রতিবেশীর সামনে স্ট্যাটাস ঠিক রাখার জন্য সুদের ঋণ নিয়ে নতুন মডেলের গাড়ি কিনলাম—সেই আত্মীয়-বন্ধু-প্রতিবেশীরা কেউ কিয়ামাতের দিন আমাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসবে না।

সেদিন আমরা যখন নিজেদের দোষে জান্নাত হারিয়ে ফেলব, তারপর ভয়ংকর কিছু সত্তা এসে নিষ্ঠুরভাবে আমাদেরকে টেনে হিঁচড়ে জাহান্নামের আগুনের দিকে নিয়ে যেতে থাকবে, তখন আমরা যতই হাহাকার করি—

  • “আমার ছেলেটা আমাকে শেষ করে দিয়েছে। ওকে ধরেন! ওর পড়ালেখার জন্য দিনরাত দৌড়াদৌড়ি করতে গিয়ে আমি নামাজ পড়তে পারিনি। ওকে নিয়ে যান, আমাকে ছেড়ে দেন!”
  • “আমার মেয়েটার জন্য আজকে আমি শেষ! ও কার না কার সাথে প্রেম করে, এই ভয়ে আমি কোচিং সেন্টারে গিয়ে বসে থাকতাম, আর নামাজ পড়তাম না। আমার বদলে ওকে ধরেন, আমাকে মাফ করে দেন!”
  • “আমার স্বামীর নিষেধের জন্য আমি হিজাব করিনি। আমার স্বামীকে জাহান্নামে নেন, আমাকে বাঁচান! আমি তো বুঝতে পারিনি এরকম হবে!”
  • “আমার বউয়ের শপিং-এর খরচের জন্য দিনরাত চাকরি-ব্যবসা করতে গিয়ে আমি ইসলাম শিখতে পারিনি। আমার দোষ নেই! আমার বউকে জাহান্নামে নেন। প্লিজ, আমাকে ছেড়ে দেন!”

—কোনো লাভ হবে না। জাহান্নামের আগুনের শিখা ক্ষুধার্ত হিংস্র বাঘের মতো আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকবে। جحيم  জাহিম হচ্ছে কোনো হিংস্র পশু শিকারের দিকে ক্ষুধার্ত হয়ে তাকিয়ে থাকা।[১] জাহান্নাম কোনো অচেতন বস্তু বা জায়গা নয় বরং এটা একটা অতিকায় ভয়ংকর দানব। একে কিয়ামতের দিন টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে আসা হবে। এটা ভীষণ গর্জন করতে করতে আসবে। এটা যেন তার শিকারের দিকে লিকলিকে শিখা বের করে ক্ষুধার্তের মতো তাকিয়ে থাকে। অপরাধীরা সেটা দেখে পালানো তো দূরের কথা, সেখান থেকে চোখ ফেরাতে পারবে না। হিংস্র আগুনের দিকে বাধ্য হয়ে তাকিয়ে থাকা, সামনে কী ভীষণ নির্যাতন আসছে সেটার বুক-ফাটা আতংক চেপে আসা — এটা হচ্ছে কেবল শুরু। আসল শাস্তি এখনো বাকি।

– ওমর আল জাবির

Like
1χλμ.
Προωθημένο
Αναζήτηση
Κατηγορίες
Διαβάζω περισσότερα
Shopping
Affordable Hellstar T-Shirt Deals and More
At Hellstar, we accept that style ought to be a thrilling and charming experience for everybody....
από Hellstar TShirt 2024-10-28 18:48:23 0 1χλμ.
Shopping
How To Easily Distinguish A Glueless Lace Wigs
Glueless Lace Front Wigs are undetectable lace wigs that attach to the detriment of glue. Of...
από Mslynnhair Mslynnhair 2023-01-03 08:51:17 0 4χλμ.
άλλο
Creating Harmony: The Interplay of Love and Financial Well-Being.
Creating harmony between love and financial well-being is essential for nurturing a balanced and...
από Billionaire Studios 2024-10-23 16:39:52 0 1χλμ.
Shopping
Audemars Piguet Royal Oak Concept Tourbillon "COMPANION"
      Audemars Piguet Collaborates with Hit Artisan KAWS on Subversive Royal Oak...
από Yexra Yexra 2024-11-20 05:53:14 0 842
Shopping
What Is The Reason You Need A 13x4 Lace Front Wig
Investing In A 13x4 Lace Wig Is A Good Idea If You Want To Increase The Volume Of Your Hair Or...
από Mslynnhair Mslynnhair 2022-11-17 07:02:36 0 3χλμ.