রায়ান - (বিজ্ঞান কল্পগল্প)

0
7K

যতদূর চোখ যায়, ধু ধু মরুভূমি। এই মরুভূমি বালির নয়। কয়লা, ছাই ও ধ্বংসাবশেষের মরুভূমি। ছাইয়ের সঙ্গে মিশে আছে মানুষ ও পশুপাখির দেহাবশেষ। খুঁজলে হাড়গোড়ও পাওয়া যাবে। সাবধানে হাঁটতে হয়, এখানে–সেখানে পড়ে আছে, লুকিয়ে আছে অবিস্ফোরিত মিসাইল, মাইন, গ্রেনেড...।

প্রখর রোদের দখলে আকাশ। সেদিকে চোখ তুলতে পারছে না রায়ান। সে মনে করার চেষ্টা করে, শেষ কবে সূর্যের মুখোমুখি হয়েছে। হাতের ডিজিটাল ডিভাইসটির দিকে তাকিয়ে সময়টা দেখে নেয় সে, ২ জুন, ৩০২০। সময়: বেলা পৌনে তিনটা। পারমাণবিক বিশ্বযুদ্ধটা হয়েছিল ৩০২০ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি। তার মানে প্রায় পাঁচ মাস ধরে তার এবং তার সহযোদ্ধারা সূর্যের দেখা পায়নি। যুদ্ধের সময় রায়ান নাসায় জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করত। নাসা যুদ্ধের ভয়াবহতার কথা মাথায় রেখে আগে থেকেই একটি বিশেষ ধরনের রেসিডেনসিয়াল স্পেসশিপ তৈরি করে রেখেছিল—বিডব্লিউ ৩০২০। বিডব্লিউ মানে ব্লু হোয়েল।

যুদ্ধ শুরু হওয়ার মাত্র দুই দিন আগে নাসার বিজ্ঞানী ও কর্মীরা সেই ব্লু হোয়েলে করে গোপনে পৃথিবীর বাইরে, লুনার ডিসটেন্সে অবস্থান নেয়। সব সুযোগ-সুবিধাসহ বিশাল স্পেসশিপে রয়েছে ৭ হাজার ৩০০ বিজ্ঞানী ও কর্মী। তাদের একজন তরুণ বিজ্ঞানী রায়ান। তারপর তো যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পৃথিবীটা রূপ নেয় জীবন্ত অগ্নিপিণ্ডে। স্পেসশিপ থেকে এই নারকীয় দৃশ্যের সাক্ষী হলো রায়ানরা। এখন মহাকাশ থেকে পৃথিবীটাকে মঙ্গল গ্রহের মতো দেখায়। পাঁচটি মাস এভাবেই মহাশূন্যে ভেসে ভেসে কেটেছে তাদের। পাশাপাশি চলছে পৃথিবী পুনরুদ্ধারের গবেষণা।

গবেষণার অংশ হিসেবেই আজ রায়ানের পৃথিবীতে অবতরণ। রায়ান বাঁ হাতের কবজিতে লাগানো ছোট্ট মনিটরে চোখ রাখে। তাকে বহনকারী ওয়ান-ম্যান ক্যাপসুলটি যে রিকভারি এরিয়ায় পড়েছে, সেটি ব্রাজিলীয় আমাজন রেইন ফরেস্টের একটি অংশ। সে ঠিক স্থানেই নেমেছে। যদিও এখন সেখানে গাছ তো দূরের কথা, একটি পাতাও অবশিষ্ট নেই।

ল্যান্ডিং পরিকল্পনামতোই হয়েছে। সমস্যা হলো, ব্লু হোয়েলের সঙ্গে যোগাযোগটা ঠিকমতো হচ্ছে না। কথা অস্পষ্ট। তা নিয়ে এখন মাথা ঘামাতে রাজি নয় সে। তার প্রথম কাজ, পৃথিবীর সারফেসের নমুনা সংগ্রহ করা। মাটিতে বসে পড়ে রায়ান। ভারি স্পেসস্যুট নিয়ে বসতে রীতিমতো কসরত করতে হয় ওকে। শুরু থেকেই গরম লাগছে তার। টের পাচ্ছে শরীর ভিজে গেছে। হেলমেটটা খুলতে পারলে স্বস্তি পাওয়া যেত। কিন্তু খুললে অন্য সমস্যা। কৃত্রিমভাবে অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ করতে হবে।

প্রয়োজনীয় নমুনা সংগ্রহ করে রায়ান। তারপর উঠে দাঁড়ায়। হেলমেট খোলার আগে এখানকার অক্সিজেনের মাত্রা পরীক্ষা করে নিতে চায় সে। এই বিরূপ পরিবেশেও অক্সিজেন নেই, তা নয়, একটু পরপর দমকা বাতাসে উড়ছে ছাই। রায়ান অক্সিজেন মিটার বের করে। অক্সিজেন লেভেল ১৮ দশমিক ২ শতাংশ। মানুষের জন্য প্রয়োজন কমপক্ষে ১৯ দশমিক ৫। পর্যাপ্ত অক্সিজেন নেই ঠিকই, কিন্তু হেলমেট খোলা যাবে। খুলতেই হবে, শুধু স্বস্তি পেতেই নয়, হেলমেটের সান ভাইসরের কারণে দূরের জিনিস স্পষ্ট দেখতেও অসুবিধা হচ্ছে তার।

হেলমেট খুলে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকে রায়ান। তারপর ধীরে ধীরে চোখ খোলে। নিঃশ্বাস নিতে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে ঠিকই, তারপরও নিজেকে হালকা অনুভব করছে। পোড়া পোড়া গন্ধ এখনো আছে। কী একটা গ্যাসের গন্ধও যেন পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু গ্যাসটিকে শনাক্ত করতে পারে না রায়ান। চারপাশটা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে সে। কোথাও তো কিছু চোখে পড়ছে না, মরুভূমির উদাম শরীর আর মরীচিকার হাতছানি ছাড়া।

কিছুটা এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় রায়ান। হাতের ডিভাইসটির দিকে তাকায়। ডিভাইস বলছে, আধা কিলোমিটারের মধ্যে একটি রিভার বেড রয়েছে। কয়েক মাস আগেও এখানে একটি খরস্রোতা নদী ছিল। সেদিকে ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করে রায়ান। হাঁটতে গিয়ে ছাই সরে যায়, বেরিয়ে আসে মানুষ ও পশুপাখির হাড়ের টুকরো। এখানে আগে ঘন বন ছিল, দালান-কোঠা ছিল না। থাকলে সেগুলোর ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যেত। রায়ানেরা ব্লু হোয়েলে বসে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখেছে, পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে এখনো কিছু লোকালয় অবশিষ্ট আছে। আছে মানুষও। তবে যুদ্ধের আগের তুলনায় তা নগণ্য।

মরুভূমি ঢেউয়ের মতো। কখনো উৎরাই, কখনো চড়াই। রায়ান শুকিয়ে যাওয়া নদীটির কাছাকাছি চলে এল। নদীর তীরে দাঁড়িয়ে সে অবাক। সামনে বিশাল এক খাদ। খাদটি সাপের মতো পশ্চিম দিক থেকে এসে পূর্ব দিকের দিগন্তরেখার সঙ্গে মিলে গেছে। এত বিশাল নদী এত দ্রুত শুকিয়ে যেতে পারে না, ভাবে রায়ান। ওর ধারণা, পারমাণবিক বোমার আঘাতে নদীর গতিপথ বদলে গেছে। নদীর ও পারটাও খাঁ খাঁ করছে। এদিক-ওদিক পর্যবেক্ষণ করতে করতেই রায়ানের চোখে পড়ে রিভার বেডের একেবারে তলায় কিছু মানুষ জড়ো হয়ে আছে। মানুষগুলোর মাঝখানে পিলারের মতো কিছু একটা দাঁড় করানো। স্পষ্ট বোঝা যায় না।

বুকের ওপর ভর দিয়ে শুয়ে পড়ে রায়ান। ভিজ্যুয়ালাইসিস বাইনোকুলারটি চোখে লাগায়। এই বাইনোকুলার দিয়ে দূরের ছবি শুধু কাছেই আসে না, দৃশ্যে থাকা বিভিন্ন উপাদান বিশ্লেষণ করে তথ্যও দেয়। জুম ইন করে দেখে, জীর্ণ পোশাকের ১০-১২ জন লোক একটা অবিস্ফোরিত পারমাণবিক বোমাকে ঘিরে নাচছে। একজন কী যেন লিখছে ওই বোমার গায়ে। বাইনোকুলারের ফ্রেমে এই দৃশ্যের পাশাপাশি ভেসে উঠছে বিভিন্ন তথ্যও। ভিজ্যুয়ালাইসিস বলছে, এরা ব্রাজিলের আদিবাসী। তারা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী টিকুনা নামে পরিচিত। ব্রাজিল ছাড়াও কলোম্বিয়া ও পেরুতেও তাদের দেখা যায়। তাদের জীবন ও জীবিকা নদীকেন্ত্রিক। তারা টিকুনা ভাষায় কথা বলে। এই গোষ্ঠীর সংগ্রামের ইতিহাসও বেশ লম্বা। অস্তিত্ব রক্ষায় তারা রক্তও দিয়েছে। কিন্তু এখন সেই ইতিহাস জানার সময় রায়ানের নেই। সে উঠে দাঁড়ায়। ওই মানুষগুলোর কাছে যেতে হবে। সে ধীরে ধীরে নিচে নামতে শুরু করে।

খাড়া হয়ে থাকা অবিস্ফোরিত পারমাণবিক বোমাটির কাছে পৌঁছানোর আগেই রায়ানকে টিকুনা গোষ্ঠীর লোকজন দেখে ফেলে। প্রথমে তারা একটু ভয় পায়। যখন নিশ্চিত হয় যে রায়ান একা, তখনই তারা আদিম অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তেড়ে আসে। রায়ান প্রস্তুত ছিল। সে তার ডিভাইসটিকে অডিও ট্রান্সলেট মোডে রেখেছে, যা টুকিনা ভাষাকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে শোনাবে। সমস্যা হলো, রায়ান টুকিনাদের ভাষা বুঝবে ঠিকই, কিন্তু নিজের ভাষা টুকিনাদের বোঝাবে কীভাবে?

টুকিনাদের ছুটে আসতে দেখে ভয় পাওয়ারই কথা। তাপরও নিজেকে স্থির রেখে রায়ান দুহাত আকাশের দিকে তুলে ধরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। টুকিনাদের বোঝাতে চায়, সে নিরস্ত্র এবং ক্ষতিকারক নয়। এতে টুকিনারা আশ্বস্ত হয়নি। তারা রায়ানকে যুদ্ধবন্দীর মতো করে ধরে নিয়ে যায়।

রায়ানের হাত-পা বাঁধা। তাকে হাঁটু গেড়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে। তার ধারণা, তাকে এখন মেরে ফেলা হবে। তাকে এখানে ধরে আনার পর সে বুঝতে পারে, এই লোকগুলো এই অবিস্ফোরিত বোমাটিকে ঈশ্বর হিসেবে মান্য করে। বোমার চারপাশে বিভিন্ন সামগ্রী রাখা। একপাশে জ্বলছে আগুন। আগুনের চারপাশে লাল রং দিয়ে বৃত্ত করা। একই লাল রং দিয়ে বোমার গায়ে বিভিন্ন প্রাগৈতিহাসিক প্রতীক আঁকা হয়েছে। টুকিনাদের যুক্তি, এই বস্তুটি যেহেতু পুরো পৃথিবী ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে, সেহেতু এটা ধ্বংসের দেবতা। এসব কথা শুনে মেজাজ বিগড়ে যায় রায়ানের। মানুষের হাতে তৈরি যে বোমা পৃথিবীটাকে শেষ করে দিয়েছে, সেই বোমাকেই কিনা পূজা করা হচ্ছে! বিধ্বংসী পারমাণবিক বোমাকে সন্তুষ্ট করতে চলছে নাচ-গান! রায়ান ইশারা-ইঙ্গিতে তাদের বোঝানোর চেষ্টা করে, ওরা যেটাকে দেবতা ভাবছে, আসলে তা নয়। কিন্তু ওরা বুঝতে রাজি নয় অথবা রায়ানের কথা পুরোপুরি বুঝতে পারছে না।

তাদের আরও স্পষ্ট করে বোঝানোর জন্য রায়ান বোমার গায়ের প্রতীকগুলো ঘষে মুছে ফেলে এবং এক ধাক্কায় বোমাটিকে মাটিতে ফেলে দেয়। এই ফেলে দেওয়াটাই তার কাল হয়। টুকিনারা তাদের দেবতার অবমাননা মেনে নিতে পারেনি। তারা রায়ানের হাত-পা বেঁধে ফেলে, বেদম প্রহার করে। ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যায় তার স্পেসস্যুট আর ডিভাইসগুলো।

রায়ান চোখ বুজে আছে। মাটির দিকে তার মুখ। কান ও মাথা থেকে দরদর করে রক্ত বের হচ্ছে। মুখের ক্ষত থেকে বের হওয়া রক্ত, নাকের ডগা পর্যন্ত এসে টপটপ করে মাটিতে পড়ছে। ছাইয়ের সঙ্গে মিশে রক্তের লাল বিলীন হয়ে যাচ্ছে। একজন টুকিনা এসে রায়ানের সামনে দাঁড়ায়। রায়ান মাথা উঁচু করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। মাথাটা ভীষণ ভারী মনে হয় ওর। চোখ খোলার চেষ্টা করে। সামান্য খোলা চোখে সে দেখে, কেউ একজন তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটার শুধু পা আর ঝুলে থাকা হাত দুটো দেখা যাচ্ছে। রায়ান এ–ও বুঝতে পারে, লোকটির হাতে মুগুরের মতো কিছু একটা আছে। সে যেন কার সঙ্গে কথা বলছে। হাতের ডিভাইসটা না থাকায় কথার অর্থ উদ্ধার করতে পারে না রায়ান। চোখ আবারও বন্ধ করে ফেলে সে।

Like
9
Site içinde arama yapın
Kategoriler
Read More
Other
Exploring Fashion: White Fox Hoodies in the UK and Eric Emanuel Shorts
Introduction to White Fox Hoodies in the UK White Fox is a trendy clothing brand known for its...
By Anderson Noah 2025-03-29 08:03:28 0 81
Shopping
ব্যবহৃত গাড়ি কেনার আগে জেনে নিন কি কি যাচাই করা দরকার?
ব্যবহৃত গাড়ি কেনার আগে জেনে নিন কি কি যাচাই করা দরকার?   গাড়ির বনেট তুলে চ্যাসিস...
By Tech News 2024-06-05 05:55:54 0 6K
Film
বিরাটের বিক্রমে আবেগে ভাসলেন আনুস্কা
এই প্রথমবার ক্রিকেটের কোন বড় আসরে বিরাট কোহলির পাশে নেই বলিউড তারকা আনুস্কা শর্মা। মেলবোর্নে যখন...
By Ekattor Television 2022-11-01 02:25:40 0 6K
Literature
Дипломированные специалисты зарабатывают больше: миф или реальность?
Купить диплом в Балашихе. В современном мире все больше людей задумываются о том, как быстро и...
By Kostya Nikiforov 2024-11-13 09:47:15 0 3K
Health
AQ Slim Weight Management Capsules Review - A Comprehensive Guide to Its Benefits
In an era where the quest for a more health-conscious lifestyle is increasingly arduous, numerous...
By Aqslim Sale 2025-03-19 16:36:33 0 294