সূরা ফাতিহা

(মুখবন্ধ)

মক্কায় অবতীর্ণ ১ম পূর্ণাঙ্গ সূরা

সূরা ১, আয়াত ৭, শব্দ ২৫, বর্ণ ১১৩।

بِسْمِ اللہِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ

পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্ল­াহর নামে (শুরু করছি)।[1]

(১) যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি জগত সমূহের প্রতিপালক।
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
(২) যিনি করুণাময় কৃপানিধান।
 الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ
(৩) যিনি বিচার দিবসের মালিক।
الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
(৪) আমরা কেবলমাত্র তোমারই ইবাদত করি এবং কেবলমাত্র তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি।
 مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ
(৫) তুমি আমাদেরকে সরল পথ প্রদর্শন কর।
 إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ
(৬) এমন ব্যক্তিদের পথ, যাদেরকে তুমি পুরস্কৃত করেছ।
اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ
(৭) তাদের পথ নয়, যারা অভিশপ্ত ও পথভ্রষ্ট হয়েছে। (আমীন! তুমি কবুল কর!)
صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ

সূরা (السُّوْرَةُ) অর্থ উঁচু স্থান, সীমানা প্রাচীর। আয়াত (الآيَةُ) অর্থ নিদর্শন। কুরআনের একাধিক আয়াত সম্বলিত একটি অংশকে ‘সূরা’ এবং অনেকগুলি আয়াত সম্বলিত এক একটি ভাগকে ‘পারা’ (الْجُزْءُ) বলা হয়। কুরআনের শব্দ ও বাক্যসমূহ আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ হিসাবে এগুলিকে আয়াত বা নিদর্শন বলা হয়। পবিত্র কুরআনে ৩০টি পারা ও ১১৪টি সূরা রয়েছে। কুরআনের সবচেয়ে বড় সূরা হ’ল ‘বাক্বারাহ’ এবং ছোট সূরা হ’ল ‘কাওছার’। প্রত্যেক সূরার শুরুতে বিসমিল্লাহ রয়েছে, কেবল সূরা তওবাহ ব্যতীত। পবিত্র কুরআনের আয়াত সংখ্যা ৬২০৪ থেকে ৬২৩৬, শব্দ সংখ্যা ৭৭৪৩৯ এবং বর্ণ সংখ্যা ৩,৪০,৭৫০ (কুরতুবী)। ঈমানের সাথে কুরআনের প্রতিটি বর্ণ পাঠে ১০টি করে নেকী হয়’।[2] রামাযান মাসে এই নেকীর পরিমাণ ১০ থেকে কেবল ৭০০ গুণ নয় বরং এর কোন সংখ্যা-সীমা থাকে না। কেননা তখন আল্লাহ নিজ হাতে সীমাহীন নেকী দান করে থাকেন।[3]

‘সূরাতুল ফাতিহাহ’ অর্থ মুখবন্ধ বা ভূমিকার সূরা। ইমাম কুরতুবী বলেন, একে ‘ফাতিহাহ’ এজন্য বলা হয় যে, এই সূরার মাধ্যমে কুরআন পাঠ শুরু করা হয়। এই সূরার মাধ্যমে কুরআনের সংকলন কাজ শুরু হয়েছে এবং এই সূরার মাধ্যমে ছালাত শুরু করা হয়’।[4] এটি মক্কায় অবতীর্ণ ১ম ও পূর্ণাঙ্গ সূরা। এতে ৭টি আয়াত, ২৫টি কালেমা বা শব্দ এবং ১১৩টি হরফ বা বর্ণ রয়েছে।[5] সূরাটি কুরআনের মূল, কুরআনের ভূমিকা ও ছালাতের প্রতি রাক‘আতে পঠিতব্য সাতটি আয়াতের সমষ্টি ‘আস-সাব‘উল মাছানী’ নামে ছহীহ হাদীছে[6] ও পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। যেমন আল্লাহপাক এরশাদ করেন, وَلَقَدْ آتَيْنَاكَ سَبْعاً مِّنَ الْمَثَانِيْ وَالْقُرْآنَ الْعَظِيْمَ ‘আমরা তোমাকে প্রদান করেছি বারবার পঠিতব্য সাতটি আয়াত ও মহান কুরআন’ (হিজর ১৫/৮৭)

১. নামকরণ :

ইমাম বুখারী (রহঃ) বলেন, সূরাটির নাম ‘উম্মুল কিতাব’ এজন্য রাখা হয়েছে যে, এই সূরার মাধ্যমেই পবিত্র কুরআনের সংকলন কার্য শুরু করা হয়েছে এবং এই সূরা পাঠের মাধ্যমে ছালাত শুরু করা হয়ে থাকে।[7] আরবরা প্রত্যেক বস্ত্তর উৎস, সারগর্ভ বস্ত্ত বা কোন কাজের অগ্রভাগ, যার অনুগামী শাখা-প্রশাখা সমূহ রয়েছে, তাকে ‘উম্ম’ (أُمٌّ) বলে। যেমন মক্কাকে উম্মুল ক্বোরা (أم القرى) বলা হয়, পৃথিবীর প্রথম ও শীর্ষ মর্যাদাবান নগরী হওয়ার কারণে এবং এটাই পৃথিবীর নাভিমূল ও এখান থেকেই পৃথিবী বিস্তৃতি লাভ করেছে’ (ইবনু জারীর, কুরতুবী, ইবনু কাছীর)। অতএব সূরা ফাতিহাকে উম্মুল কুরআন (أم القرأن) এজন্য বলা হয়েছে যে, এটা দিয়েই কুরআন শুরু হয়েছে এবং এর মধ্যে কুরআনের সমস্ত ইল্ম শামিল রয়েছে’ (কুরতুবী)

সূরা ফাতিহার নাম সমূহ :

বিভিন্ন হাদীছ, আছার ও বিদ্বানগণের নামকরণের মাধ্যমে অন্যূন ৩০টি নাম বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে ছহীহ হাদীছসমূহে এসেছে ৮টি। যেমন : (১) উম্মুল কুরআন (কুরআনের মূল)। (২) উম্মুল কিতাব (কিতাবের মূল)। (৩) আস-সাব‘উল মাছানী (সাতটি বারবার পঠিতব্য আয়াত)। (৪) আল-কুরআনুল ‘আযীম (মহান কুরআন)।[8] (৫) আল-হামদু (যাবতীয় প্রশংসা)। (৬) ছালাত।[9] (৭) রুক্বিয়াহ (ফুঁকদান)।[10] (৮) ফাতিহাতুল কিতাব (কুরআনের মুখবন্ধ)।[11] এ নামে সকল বিদ্বান একমত। কারণ এ সূরা দিয়েই কুরআন পাঠ শুরু হয়। কুরআনুল কারীম লেখা শুরু হয় এবং এটা দিয়েই ছালাত শুরু হয় (কুরতুবী)

এতদ্ব্যতীত অন্য নামগুলি যেমন : (৯) শিফা (আরোগ্য)[12], (১০) আসাসুল কুরআন (কুরআনের ভিত্তি)। ইবনু আববাস (রাঃ) এ নামকরণ করেছেন (ইবনু কাছীর)। (১১) কাফিয়াহ (যথেষ্ট)। ইয়াহইয়া ইবনু আবী কাছীর এ নামকরণ করেছেন। কারণ এটুকুতেই ছালাত যথেষ্ট এবং এটি ব্যতীত ছালাত হয় না (কুরতুবী)। (১২) ওয়াফিয়াহ (পূর্ণ)। সুফিয়ান বিন উয়ায়না এ নামকরণ করেছেন। কারণ এ সূরাটি সর্বদা পূর্ণভাবে পড়তে হয়। আধাআধি করে দু’রাক‘আতে পড়া যায় না (কুরতুবী)। (১৩) ওয়াক্বিয়াহ (হেফাযতকারী)। (১৪) কান্য (খনি)। এছাড়াও ফাতিহাতুল কুরআন, সূরাতুল হাম্দ, শুক্র, ফাতিহাহ, মিন্নাহ, দো‘আ, সওয়াল, মুনাজাত, তাফভীয, মাসআলাহ, রা-ক্বিয়াহ, নূর, আল-হাম্দুলিল্লাহ, ইল্মুল ইয়াক্বীন, সূরাতুল হাম্দিল ঊলা, সূরাতুল হাম্দিল কুছরা’। এইভাবে নাম বৃদ্ধির ফলে সূরা ফাতিহার মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে।[13]

প্রকাশ থাকে যে, পবিত্র কুরআনের সূরা সমূহের এক বা একাধিক নামকরণ, মাক্কী ও মাদানী সূরার আগে-পিছে সংযোজন ও আয়াত সমূহের বিন্যস্তকরণ সবকিছু ‘তাওক্বীফী’ অর্থাৎ আল্লাহর ‘অহি’ কর্তৃক প্রত্যাদিষ্ট ও রাসূল (ছাঃ) কর্তৃক সন্নিবেশিত, যা অপরিবর্তনীয়।[14] এর মধ্যে গূঢ় তত্ত্বসমূহ নিহিত রয়েছে।

অবতরণকাল :

সর্বপ্রথম সূরা ‘আলাক্ব-এর প্রথম পাঁচটি আয়াত মক্কায় নাযিল হয়।[15] অতঃপর কয়েক দিন অহি-র বিরতিকাল শেষে সূরা মুদ্দাছ্ছির-এর প্রথম ৫টি আয়াত নাযিল হয়।[16] অন্য বর্ণনায় ৭টি আয়াতের কথা এসেছে।[17] তারপরে সর্বপ্রথম পূর্ণাংগ সূরা হিসাবে সূরা ফাতিহা নাযিল হয়।[18]

বিষয়বস্ত্ত :

সূরা ফাতিহার মূল বিষয়বস্ত্ত হ’ল দো‘আ বা প্রার্থনা। একারণেই এই সূরার অন্যতম নাম হ’ল ‘সূরাতুদ দু‘আ’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,أَفْضَلُ الذِّكْرِ لآ إِلَهَ إِلاَّ الله ُوَأَفْضَلُ الدُّعَاءِ اَلْحَمْدُ ِللهِ ‘শ্রেষ্ঠ যিক্র হ’ল লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ এবং শ্রেষ্ঠ দো‘আ হ’ল ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বা সূরা ফাতিহা’।[19]এর দ্বারা একথাই বুঝানো হয়েছে যে, মহাগ্রন্থ আল-কুরআন হ’তে ফায়েদা পেতে গেলে তাকে অবশ্যই উক্ত নিয়তে আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করতে হবে। এই সূরাতে বর্ণিত মূল দো‘আ হ’ল ৫ম আয়াত, إِهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيْمَ ‘তুমি আমাদেরকে সরল পথ প্রদর্শন কর’! বস্ত্ততঃ সমস্ত কুরআনই উক্ত প্রার্থনার বিস্তারিত জওয়াব।

দো‘আর আদব :

অত্র সূরাতে দো‘আ করার আদব শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। ১ম হ’তে ৩য় আয়াত পর্যন্ত যার নিকটে প্রার্থনা করা হবে, সেই মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর প্রশংসা করা হয়েছে। অতঃপর ৪র্থ আয়াতে তাঁর প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রদর্শন করা হয়েছে ও কেবলমাত্র তাঁর নিকট থেকেই সাহায্য কামনার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে। অতঃপর ৫ম আয়াতে মূল দো‘আর বিষয়বস্ত্ত ছিরাতে মুস্তাক্বীম-এর হেদায়াত প্রার্থনা করা হয়েছে। ৬ষ্ঠ ও ৭ম আয়াতদ্বয় মূলতঃ ৫ম আয়াতের ব্যাখ্যা হিসাবে এসেছে। এইভাবে প্রার্থনা নিবেদন শেষে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদেরকে আল্লাহর নিকটে ‘আমীন’ বলে দো‘আ কবুলের আবেদন করতে বলেছেন। মোটকথা প্রথমে প্রশংসা ও আনুগত্য নিবেদন করার পরে দো‘আ পেশ করা হয়েছে। একইভাবে ছালাতের বাইরে আল্লাহর জন্য হাম্দ ও রাসূল (ছাঃ)-এর উপর দরূদ পেশ করার পরে দো‘আ করা হ’ল দো‘আর সুন্নাতী তরীকা।[20]

এই সূরাতে ‘ছিরাতে মুস্তাক্বীম’-এর হেদায়াত প্রার্থনা করা হয়েছে। আর এই হেদায়াত পাওয়ার উপরেই বান্দার ইহকালীন মঙ্গল ও পরকালীন মুক্তি নির্ভর করে। সম্ভবতঃ একারণেই ছালাতের প্রতি রাক‘আতের শুরুতে ইমাম ও মুক্তাদী সকল মুছল্লীর জন্য জেহরী ও সের্রী সকল ছালাতে এই সূরা পাঠ করা ফরয করা হয়েছে। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,لاَ صَلاَةَ لِمَنْ لَمْ يَقْرَأْ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ ‘ঐ ব্যক্তির ছালাত সিদ্ধ নয়, যে ব্যক্তি সূরায়ে ফাতিহা পাঠ করে না’।[21]সম্ভবতঃ একারণেই সূরায়ে ফাতিহার অন্যতম নাম হ’ল ‘ছালাত’। অর্থাৎ যা ব্যতীত ‘ছালাত’ সিদ্ধ হয় না। যদিও অনেক বিদ্বান ইমামের পিছনে সূরায়ে ফাতিহা পাঠ করাকে অসিদ্ধ বলেন। অথচ এর পক্ষে ছহীহ হাদীছ থেকে কোন দলীল নেই। তাছাড়া ছালাতের শুরুতে আল্লাহর প্রশংসা বাদ দিয়ে কিভাবে উক্ত ছালাত ও ইবাদত কবুল হ’তে পারে?

ফাযায়েল :

(১) এই সূরা কুরআনের সর্বাধিক মর্যাদামন্ডিত সূরা। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, যার হাতে আমার জীবন তার কসম করে বলছি, তাওরাত, যবূর, ইনজীল এবং কুরআনে এই সূরার তুলনীয় কোন সূরা নেই।[22]

(২) এই সূরা এবং সূরায়ে বাক্বারাহর শেষ তিনটি আয়াত হ’ল আল্লাহর পক্ষ হ’তে প্রেরিত বিশেষ নূর, যা ইতিপূর্বে কোন নবীকে দেওয়া হয়নি।[23]

গুরুত্ব :

যে ব্যক্তি ছালাতের মধ্যে সূরা ফাতিহা পাঠ করল না, তার ছালাত অপূর্ণাঙ্গ ও বিকলাঙ্গ (خِدَاجٌ)। আবু ওবায়েদ বলেন, ‘খিদাজ’ হ’ল গর্ভচ্যুত মৃত সন্তান যা কোন কাজে আসে না।[24] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এ কথাটি তিনবার বলেন। রাবী হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হ’ল, যখন আমরা ইমামের পিছনে থাকি? জওয়াবে তিনি বলেন, إِقْرَأْ بِهَا فِىْ نَفْسِكَ ‘তখন তুমি ওটা চুপে চুপে পড়’। কেননা আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, আল্লাহ বলেন, قَسَّمْتُ الصَّلاَةَ بَيْنِيْ وَ بَيْنَ عَبْدِىْ نِصْفَيْنِ. ‘ছালাতকে অর্থাৎ সূরা ফাতিহাকে আমি আমার ও আমার বান্দার মধ্যে দু’ভাগে ভাগ করেছি। আর আমার বান্দা যা চাইবে তাই পাবে। যখন সে বলে, আলহামদুলিল্লাহ..’ তখন আল্লাহ বলেন, حَمِدَنِىْ عَبْدِىْ ‘আমার বান্দা আমার প্রশংসা করেছে’। যখন সে বলে, ‘আর রহমা-নির রহীম’ তখন আল্লাহ বলেন, أَثْنَى عَلَىَّ عَبْدِىْ ‘আমার বান্দা আমার গুণ বর্ণনা করেছে’। যখন সে বলে, ‘মা-লিকি….’ তখন আল্লাহ বলেন, مَجَّدَنِىْ عَبْدِىْ ‘বান্দা আমার মর্যাদা বর্ণনা করেছে’। যখন সে বলে, ইইয়াকা না‘বুদু.. তখন আল্লাহ বলেন, هَذَا بَيْنِىْ وَبَيْنَ عَبْدِىْ وَلِعَبْدِىْ مَا سَأَلَ ‘এটি আমার ও আমার বান্দার মধ্যে বিভক্ত। আর আমার বান্দা যা চাইবে, তাই পাবে’। অতঃপর যখন সে বলে, ‘ইহ্দিনাছ ছিরাত্বাল … ওয়াল লায্  যা-ল্লীন’ তখন আল্লাহ বলেন, هَذَا لِعَبْدِىْ وَلِعَبْدِىْ مَا سَأَلَ ‘এটি সম্পূর্ণ আমার বান্দার জন্য। আর আমার বান্দা যা চেয়েছে, তাই পাবে।[25] অত্র হাদীছে জেহরী ছালাতে ইমামের পিছনে চুপে চুপে সূরা ফাতিহা পাঠের স্পষ্ট বক্তব্য এসেছে। অতএব জেহরী বা সের্রী সকল ছালাতে ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পাঠ করা ফরয। ছাহাবীর ব্যাখ্যা পাওয়ার পরে অন্য কারু মতামতের প্রতি দৃকপাত করা ঠিক হবে না।

ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, ‘এই সূরার নাম ‘ছালাত’ (الصلاة) বলা হয়েছে একারণে যে, ছালাতের জন্য এটি পাঠ করা সবচেয়ে বড় রুকন’ (ঐ, তাফসীর সূরা ফাতিহা)। তিনি বলেন, ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) এবং যেসকল বিদ্বান ছালাতে সূরা ফাতিহা পাঠ করা ফরয বলেন না, তাদের প্রধান দলীল হ’ল, فَاقْرَءُوْا مَا تَيَسَّرَ مِنَ الْقُرْآنِ ‘তোমরা কুরআন থেকে যা সহজ হয়, ততটুকু পাঠ কর’ (মুযযাম্মিল ৭৩/২০)। অথচ আয়াতের পূর্বাপর সম্পর্ক বিবেচনায় জমহূর বিদ্বানগণের নিকট এখানে ‘কুরআন’ অর্থ ছালাত। অর্থাৎ তোমাদের পক্ষে যতটুকু সহজ হয়, ততটুকু রাত্রি জাগরণ কর। কুরআন তেলাওয়াত যেহেতু ছালাতের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সেকারণে এখানে ‘কুরআন’ বলা হয়েছে। যেমন অন্যত্র আল্লাহ বলেন, إِنَّ قُرْآنَ الْفَجْرِ كَانَ مَشْهُوْدًا ‘নিশ্চয়ই ফজরের কুরআন অর্থাৎ ছালাত (দিবস বা রাত্রির বদলী ফেরেশতাদ্বয়ের) একত্রিত হওয়ার সময়কাল’ (ইসরা ১৭/৭৮; ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা মুযযাম্মিল ২০)

(২) উবাদাহ বিন ছামিত (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,لاَ صَلاَةَ لِمَنْ لَّمْ يَقْرَأْ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ (‘লা ছালা-তা লিমান লাম ইয়াক্বরা’ বিফা-তিহাতিল কিতা-ব’) ‘ঐ ব্যক্তির ছালাত সিদ্ধ নয়, যে ব্যক্তি সূরা ফাতিহা পাঠ করে না’।[26]

(৩) আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,لاَ تُجْزِئُ صَلاَةٌ لاَ يُقْرَأُ فِيْهَا بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ ‘ঐ ছালাত সিদ্ধ নয়, যাতে সূরা ফাতিহা পাঠ করা হয় না’…। [27]

(৪) হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, একদা এক সফরে আমাদের এক সাথী জনৈক গোত্রপতিকে শুধুমাত্র সূরা ফাতিহা পড়ে ফুঁক দিয়ে সাপের বিষ ঝাড়েন ও তিনি সুস্থ হন…।[28] এজন্য এ সূরাকে রাসূল (ছাঃ) ‘রুক্বইয়াহ’ (الرُّقْيَةُ) বলেছেন।[29] কেননা এই সূরা পড়ে ফুঁক দিলে আল্লাহর হুকুমে রোগী সুস্থ হয়ে যায়।

(৫) ইমাম কুরতুবী বলেন, সূরা ফাতিহাতে যে সকল ‘ছিফাত’ রয়েছে, তা অন্য কোথাও নেই। এমনকি একেই ‘আল-কুরআনুল আযীম’ বা মহান কুরআন বলা হয়েছে (হিজর ১৫/৮৭)।

এই সূরার ২৫টি কলেমা কুরআনের যাবতীয় ইল্মকে শামিল করে। এই সূরার বিশেষ মর্যাদা এই যে, আল্লাহ এটিকে নিজের ও নিজের বান্দার মধ্যে ভাগ করে নিয়েছেন। একে বাদ দিয়ে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা সম্ভব নয়। সেজন্যই একে ‘উম্মুল কুরআন’ বা ‘কুরআনের সারবস্ত্ত’ বলা হয়েছে। পবিত্র কুরআন মূলতঃ তিনটি বিষয়ে বিভক্ত। তাওহীদ, আহকাম ও নছীহত। সূরা ইখলাছে ‘তাওহীদ’ পূর্ণাঙ্গভাবে থাকার কারণে তা কুরআনের এক তৃতীয়াংশের মর্যাদা পেয়েছে। কিন্তু সূরা ফাতিহাতে তিনটি বিষয় একত্রে থাকার কারণে তা ‘উম্মুল কুরআন’ হওয়ার মহত্তম মর্যাদা লাভে ধন্য হয়েছে।[30]

ফায়েদা :

সূরা ফাতিহাকে অনেকে বিদ‘আতী কাজে ব্যবহার করেন, যা অবশ্যই পরিত্যাজ্য। যেমন কবর যিয়ারতের সময় ফাতিহা পাঠ করা, বরকত হাছিলের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন উপলক্ষে সূরা ফাতিহা পাঠ করা, নির্দিষ্ট সংখ্যক বার ফাতিহা পাঠ করে দো‘আ করা, খুৎবা, দো‘আ বা ওয়ায-নছীহতের শুরু বা শেষে সূরা ফাতিহা পাঠ করা, ফজরের আযানের পূর্বে বা পরে মাইকে সূরা ফাতিহা পাঠ করা, সম্মিলিত দো‘আর জন্য হাত উঠানোর পূর্বে সকলকে ফাতিহা পড়তে বলা, মজলিস শেষে ফাতিহা পাঠ, মৃতের পাশে বসে ফাতিহা পাঠ, কবরে মাথার দিকে দাঁড়িয়ে সূরা ফাতিহা ও পায়ের দিকে দাঁড়িয়ে সূরা বাক্বারাহর শুরুর অংশ পড়া, দাফনের সময় সূরা ফাতিহা, ক্বদর, কাফিরূন, নছর, ইখলাছ, ফালাক্ব ও নাস এই সাতটি সূরা বিশেষভাবে পাঠ করা, কবরের সামনে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে সূরা ফাতিহা ১ বার ও ইখলাছ ১১ বার অথবা সূরা ইয়াসীন ১ বার পাঠ করা ইত্যাদি। অথচ ছহীহ হাদীছসমূহে কঠোর নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও অনেকে জেহরী বা সের্রী ছালাতে ইমামের পেছনে সূরা ফাতিহা পাঠ করেন না। মনে রাখা আবশ্যক যে, দো‘আ হ’ল ইবাদত। যার নিয়ম-পদ্ধতি শরী‘আত কর্তৃক নির্ধারিত। যা অপরিবর্তনীয়। এখানে খেয়াল-খুশীমত কোন কাজ করা যায় না। বড় কথা হ’ল এই যে, বিদ‘আতের মাধ্যমে কোন ইবাদত কবুল হয় না।

তাফসীর :

আঊযুবিল্লাহ ও বিসমিল্লাহ পাঠ :

আল্লাহ বলেন, وَقُلْ رَبِّ أَعُوْذُ بِكَ مِنْ هَمَزَاتِ الشَّيَاطِيْنِ، وَأَعُوْذُ بِكَ رَبِّ أَنْ يَّحْضُرُوْنِ ‘তুমি বল, হে আমার প্রতিপালক! আমি তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করি শয়তানের প্ররোচনা হ’তে’। ‘হে আমার প্রতিপালক! আমি তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করি আমার নিকট ওদের উপস্থিতি হ’তে’ (মুমিনূন ২৩/৯৭-৯৮)। তিনি বলেন, وَإِمَّا يَنْزَغَنَّكَ مِنَ الشَّيْطَانِ نَزْغٌ فَاسْتَعِذْ بِاللهِ إِنَّهُ هُوَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْمُ ‘যদি শয়তানের কুমন্ত্রণা তোমাকে প্ররোচিত করে, তবে আল্লাহর আশ্রয় চাও। নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’ (হা-মীম সাজদাহ/ফুছছিলাত ৪১/৩৬)। তিনি বলেন, فَإِذَا قَرَأْتَ الْقُرْآنَ فَاسْتَعِذْ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ ‘যখন তুমি কুরআন পাঠ করবে, তখন অভিশপ্ত শয়তান হ’তে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করবে’ (নাহল ১৬/৯৮)

উপরোক্ত আয়াতসমূহের আলোকে বিদ্বানগণ বলেন, ছালাতের মধ্যে বা বাইরে কুরআন পাঠের শুরুতে শয়তানের ধোঁকা হ’তে আল্লাহর নিকটে পানাহ চেয়ে ‘আঊযুবিল্লাহ….’ পাঠ করা, অতঃপর আল্লাহর নামে ক্বিরাআত শুরু করার সংকল্প করে ‘বিসমিল্লাহ…’ পাঠ করা মুস্তাহাব।[31] ছালাতের শুরুতে ছানা বা দো‘আয়ে ইস্তেফতাহ পাঠ শেষে আঊযুবিল্লাহ কেবল ১ম রাক‘আতে পড়বে, বাকী রাক‘আতগুলিতে নয়।[32] জেহরী ছালাতে ‘বিসমিল্লাহ…’ চুপে চুপে পড়ার দলীল অধিকতর স্পষ্ট ও মযবুত।[33] তবে যে সকল বিদ্বান বিসমিল্লাহ-কে সূরায়ে ফাতিহার অন্যতম আয়াত মনে করেন, তাঁরা জেহরী ছালাতে অন্য আয়াতের ন্যায় এটিকেও জোরে পড়ার পক্ষে মত প্রকাশ করেন।[34] মূলতঃ ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম’ মক্কায় অবতীর্ণ সূরা নমল-এর ৩০ আয়াতের অংশ বিশেষ, যা সাবা-র রাণী বিলক্বীস-এর নিকটে লিখিত পত্রের শুরুতে হযরত সুলায়মান (আঃ) লিখেছিলেন।[35] এই আয়াত নাযিলের পূর্বে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ‘বিসমিকা আল্লাহুম্মা’ লিখতেন। পরে ‘বিসমিল্লাহ’ লিখতে শুরু করেন। কুরআন মাজীদের বিভিন্ন সূরার মধ্যে পার্থক্য বুঝানোর জন্য সূরা তওবা ব্যতীত অন্য সকল সূরার প্রথমে ‘বিসমিল্লাহ’ লিখিত ও পঠিত হয়। অমনিভাবে বই ও চিঠি-পত্রের শুরুতে বরকত হাছিলের উদ্দেশ্যে ‘বিসমিল্লাহ’ লেখা সম্পর্কে উম্মতের ঐক্যমত রয়েছে।[36]

বিসমিল্লাহর শুরুতে إسم বা নাম কথাটি বৃদ্ধি করা হয়েছে আল্লাহর মর্যাদা আরও সমুন্নত করার জন্য এবং যাতে ‘বিল্লাহ’ শব্দ দ্বারা কসম বা শপথ না বুঝায়, সেজন্য। অধিক ব্যবহারের কারণে باسم থেকে আলিফ বিলুপ্ত করে بسم করা হয়েছে। اِقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ তে আলিফ মওজুদ আছে অপেক্ষাকৃত কম ব্যবহারের কারণে।

اَللهُ হ’ল বিশ্বপ্রভুর সত্তাগত নাম বা ‘ইসমে আ‘যম’ (الإسم الأعظم)। বাকী নামসমূহ এর অনুগামী ও গুণবাচক নাম। বিশ্বপ্রভুর সত্তা ব্যতীত ‘আল্লাহ’ নাম অন্য কারু জন্য প্রযোজ্য নয়। আরবী বা অন্য কোন ভাষায় এই নামের কোন প্রতিশব্দ নেই। অতএব আল্লাহ-এর বদলে খোদা, ঈশ্বর, ভগবান, গড, উপরওয়ালা ইত্যাদি বলা যাবে না। ‘আল্লাহ’ নামের কোন স্ত্রীলিঙ্গ, দ্বিবচন বা বহুবচন নেই। উলূহিয়াতের সকল গুণাবলীর ধারক হ’লেন আল্লাহ। তিনিই একমাত্র মা‘বূদ। তিনি চিরঞ্জীব ও বিশ্ব চরাচরের ধারক।

أَلَهَ يَلَهُ إِلَهَةً أُلُوْهِيَّةً অর্থ উপাসনা করা। সেখান থেকে مَأْلُوْهٌ অর্থ مَعْبُوْدٌ উপাস্য। অধিকাংশ বিদ্বানের মতে ‘আল্লাহ’ শব্দটি ‘মুশতাক্ব’, যা إِلاَهٌ মাদ্দাহ হ’তে উদ্গত। ওযন فِعَالٌ। إِلاَهٌ -এর উপরে اَلْ প্রবেশ করানোর পর (اَلْإِلَهُ) হালকা করার জন্য ‘হামযাহ’ ফেলে দিয়ে اَللهُ করা হয়েছে ‘সম্মান’ বুঝানোর জন্য। উক্ত اَلْ সর্বদা আবশ্যিক থাকবে। কখনোই পৃথক করা যাবে না। যাহহাক বলেন, إِنَّمَا سُمِّىَ اللهُ إِلٰهًا لان الخلق يتألَّهُوْن إليه فى حوائجهم ‘আল্লাহ’-কে ‘ইলাহ’ এজন্য বলা হয়েছে যে, সৃষ্টিকুল স্ব স্ব প্রয়োজনে হয়রান ও নিরাশ হয়ে তাঁর কাছেই উপনীত হয় (কুরতুবী ১/১৩৯-৪০)

ফায়েদা :

আজকাল আরবীতে আললাহ (الله) লিখে তা বিভিন্ন মসজিদে, গাড়ীর মাথায়, বাড়ীতে ও বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে ব্যবহার করা হচ্ছে। যা নিঃসন্দেহে বিদ‘আত ও চরম বেআদবীও বটে। অনেকে একপাশে আরবীতে ‘আল্লাহ’ (الله) অন্যপাশে ‘মুহাম্মাদ’ (محمد) লিখেন। যার মাধ্যমে উভয়কে মর্যাদার দিক থেকে সমান গণ্য করা হয় এবং বরকত হাছিলের উদ্দেশ্যে এগুলি করা হয়। অথচ শরী‘আতে এর কোন দলীল নেই। এগুলি শয়তানী ধোঁকা ব্যতীত কিছু নয়। এসব থেকে তওবা না করে মারা গেলে পরকালে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে।

رَحْمٰنٌ ‘রহমান’ ও ‘রহীম’ দু’টিই ‘মুশতাক্ব’ যা রহম (الرَّحْمَةُ) মাদ্দাহ হ’তে উদ্গত। অর্থ দয়া, অনুগ্রহ। ‘রহমান’ দ্বারা রহম বা অনুগ্রহের আধিক্য বুঝানো হয়েছে, যা সকল ধরনের অনুগ্রহকে শামিল করে। এটি আল্লাহর জন্য খাছ। এই বিশেষণ অন্যের জন্য সিদ্ধ নয়। যেমন আল্লাহ বলেন, قُلِ ادْعُوا اللهَ أَوِ ادْعُوا الرَّحْمَنَ أَيًّا مَّا تَدْعُوا فَلَهُ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَى ‘তোমরা ‘আল্লাহ’ নামে আহবান কর বা ‘রহমান’ নামে আহবান কর, যে নামেই তোমরা ডাক, তাঁর সব নামই সুন্দর’ (ইসরা ১৭/১১০)। এখানে ‘রহমান’কে আল্লাহ নামের সমান গণ্য করা হয়েছে, যার সাথে কাউকে শরীক করা যাবে না। অন্যত্র তিনি বলেন,وَاسْأَلْ مَنْ أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رُسُلِنَا أَجَعَلْنَا مِنْ دُوْنِ الرَّحْمٰنِ آلِهَةً يُعْبَدُوْنَ ‘ তোমার পূর্বে আমরা যেসব রাসূল প্রেরণ করেছিলাম, তাদেরকে তুমি জিজ্ঞেস কর আমরা কি ‘রহমান’ (আল্লাহ) ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নির্ধারণ করেছিলাম, যাদের ইবাদত করা যায়? (যুখরুফ ৪৩/৪৫)। এখানে আল্লাহকে ‘রহমান’ বলা হয়েছে।

رَحِيْمٌ আল্লাহ ও বান্দা সবার জন্য বিশেষণ হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছিফাত হিসাবে পবিত্র কুরআনে رَؤُوْفٌ رَحِيْمٌ বিশেষণ দু’টি ব্যবহৃত হয়েছে (তওবা ৯/১২৮)। তাছাড়া আল্লাহ মুমিনদের প্রতি বিশেষ অনুগ্রহশীল বুঝানোর জন্য এটি ব্যবহৃত হয়। যেমন বলা হয়েছে, وَكَانَ بِالْمُؤْمِنِيْنَ رَحِيْمًا ‘নিশ্চয়ই তিনি মুমিনদের প্রতি পরম দয়ালু’ (আহযাব ৩৩/৪৩)

দুনিয়া ও আখেরাতে আল্লাহর অনুগ্রহের ব্যাপকতা বুঝানোর জন্য দু’টো একই গুণবাচক শব্দকে একই স্থানে একত্রে ব্যবহার করা হয়েছে। কেননা আল্লাহর রহমত তাঁর ক্রোধকে পরাভূত করে[37] إنَّ رَحْمَتىْ سَبَقَتْ غَضَبِىْ (متفق عليه) এবং তাঁর রহমত সকল কিছুতেই ব্যাপ্ত রয়েছে رَحْمَتِيْ وَسِعَتْ كُلَّ شَيْءٍ (আ‘রাফ ৭/১৫৬)

বিভিন্ন শুভ কাজের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ বলা মুস্তাহাব। এ বিষয়ে বহু হাদীছ এসেছে। ‘বিসমিল্লাহ’ হ’ল দুষ্ট জিন ও মানুষের লজ্জাস্থানের পর্দা স্বরূপ।[38] গৃহে প্রবেশ করা ও বের হওয়া, বাড়ীর দরজা বন্ধ করা, বাতি নেভানো, পাত্র ঢাকা, বোতলের মুখ লাগানো, চুক্তিনামায় স্বাক্ষর করা, ওযূ-গোসল, খানা-পিনা, যবহ ইত্যাদি সকল শুভ কাজের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ বলার জন্য হাদীছে স্পষ্টভাবে নির্দেশ এসেছে। শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ বলতে ভুলে গেলে بِسْمِ اللهِ أَوَّلَهُ وآخِرَهُ বলতে হবে।[39] কিন্তু যেসকল ইবাদতের পূর্বে ‘বিসমিল্লাহ’ বলার বিধান নেই, সেসবের শুরুতে তা বলা যাবে না। যেমন আযান, ইক্বামত, ছালাত প্রভৃতির শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ বলা। ওছমান বিন আবুল ‘আছ ইসলাম গ্রহণের পর থেকে ব্যথার অসুখে আক্রান্ত ছিলেন। রাসূলুললাহ (ছাঃ) তাঁকে ব্যথার স্থানে হাত রেখে তিনবার ‘বিসমিল্লাহ’ বলতে ও সাত বার أَعُوْذُ بِعِزَّةِ اللهِ وَقُدْرَتِهِ مِنْ شَرِّ مَا أَجِدُ وَأُحَاذِرُ পাঠ করতে আদেশ দিলেন এবং তাতে তিনি সুস্থ হয়ে গেলেন’।[40]

সকল শুভ কাজের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ বলার মধ্যে তাকদীরকে অস্বীকারকারী ভ্রান্ত ফিরকা ‘ক্বাদারিয়া’ ও তাদের অনুসারীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ রয়েছে। কেননা তাদের ধারণা মতে বান্দার কাজ তার নিজ ইচ্ছাধীন। এখানে আল্লাহর ইচ্ছার কোন প্রতিফলন নেই। অথচ আল্লাহ পাক আমাদেরকে সকল কাজের শুরুতে আল্লাহর সাহায্য ও তাওফীক কামনার নির্দেশ দিয়েছেন। কেননা আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত বান্দার কোন ইচ্ছাই পূরণ হ’তে পারে না। তিনিই কর্মের স্রষ্টা ও বান্দা কর্মের বাস্তবায়নকারী মাত্র। তাছাড়া শুধুমাত্র আমল কাউকে জান্নাতে নিয়ে যেতে পারবে না, যদি না আল্লাহর রহমত থাকে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, لاَ يُدْخِلُ أحدًا منكم عملُه الجنةَ وَلاَ يُجِيْرُهُ مِنَ النَّارِ وَلاَ أَنَا إِلاَّ بِرَحْمَةِ اللهِ ‘কারু আমল তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে না কিংবা জাহান্নাম থেকে রেহাই দেবে না, এমনকি আমাকেও নয়, আল্লাহর রহমত ব্যতীত’।[41] তাই শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ পাঠের মাধ্যমে মূলতঃ আল্লাহর রহমত ও অনুগ্রহ কামনা করা হয়।

بِسْمِ اللهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ : ‘পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে (শুরু করছি)’। এতে ৪টি শব্দ ও ১৯টি বর্ণ রয়েছে। বাক্যের প্রথমে اِبْتَدَأْتُ অর্থাৎ ‘আমি শুরু করছি’ ক্রিয়াটি উহ্য রয়েছে। ‘বিসমিল্লাহ’ অর্থ আল্লাহর নামের সাথে, তাঁর নামের সাহায্যে ও তাঁর নামের বরকতে। বিসমিল্লাহ বলার সময় উহ্য ক্রিয়াটির নিয়ত করতে হবে। নইলে ওটা কেবল পাঠ করাই সার হবে। যেমন বিসমিল্লাহি আক্বরাউ (আল্লাহর নামে আমি পড়া শুরু করছি)। বিসমিল্লাহি আ-কুলু (আল্লাহর নামে আমি খেতে শুরু করছি) ইত্যাদি। আরবী বা বাংলায় মুখে নিয়ত পড়া বিদ‘আত। বরং হৃদয়ে আল্লাহর নামে উক্ত শুভ কাজের সংকল্প করতে হবে।

এখানে ক্রিয়াপদকে উহ্য রাখার কারণ হ’তে পারে দু’টি : (১) শুরুতেই আল্লাহ নামের বরকত হাছিল করা (২) অন্য কারু সাহায্যে নয়, কেবল আল্লাহর সাহায্যে আমি কর্ম শুরু করছি, সেটা বুঝানো। এটি সূরা নমলের ৩০ আয়াত। কিন্তু এ আয়াতটিকে পবিত্র কুরআনের সূরা সমূহের মধ্যে পার্থক্যকারী হিসাবে প্রত্যেক সূরার শুরুতে রাখা হয়েছে। কেবল সূরা তওবার শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ রাখা হয়নি। এর রহস্য আল্লাহ ভাল জানেন। যদিও ড. আহমাদ দীদাত (১৯১৮-২০০৫ খৃঃ) ও অনেকে এর মাধ্যমে ১৯ সংখ্যার মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে চেয়েছেন। কারণ সেটা থাকলে সূরা নমলের ৩০ আয়াতের বিসমিল্লাহ সহ কুরআনে ১১৫টি বিসমিল্লাহ হবে। যা ১৯ দিয়ে গুণ করলে মিলত না।

যুগে যুগে বিজ্ঞান যত এগিয়ে যাবে, কুরআনের বিভিন্ন অলৌকিক বিষয় তেমনি মানুষের সামনে খুলে যাবে। তবে সাবধান থাকতে হবে যেন এর দ্বারা কোন ভ্রান্ত আক্বীদা জন্ম না নেয়। যেমন ইরানের বাহাঈরা ইতিমধ্যে ১৯ তত্ত্বে বাড়াবাড়ি করে পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে। উল্লেখ্য যে, বাহাঈ ইরানের একটি কাফির ধর্মীয় সম্প্রদায়। খৃষ্টীয় ঊনবিংশ শতাব্দীতে আবির্ভাব হওয়ায় এরা ১৯ সংখ্যাকে পবিত্র মনে করে। এই ধর্মের মতে ১৯ দিনে মাস হয়, ১৯ মাসে বছর হয়। রামাযানের ছিয়াম ১৯ দিন রাখতে হয় এবং সম্পদের যাকাত ১৯ শতাংশ দিতে হয়। তালাক ১৯ বার দেওয়া যায়। তাদের ধর্মগ্রন্থ আল-বায়ানের (البيان العربى) অনুচ্ছেদ সংখ্যা ১৯। তারা এটিকে কুরআনের রহিতকারী (ناسخ) মনে করে। কুরআনকে বাহাঈ ধর্মের সত্যতার পক্ষে ব্যবহার করার জন্য কিছু লোক কুরআনের সূরা, আয়াত, শব্দ, বর্ণ সবকিছুকে ১৯ দিয়ে মিলাতে গলদঘর্ম হয়েছেন। অথচ এই গণনা ইতিমধ্যেই বাতিল প্রমাণিত হয়েছে। জনৈক মিসরীয় ড. রাশাদ খলীফা (১৯৩৫-১৯৯৩ খৃঃ) একাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে অবশেষে নাস্তিক হয়েছেন ও নিহত হয়েছেন।

আল্লাহ বলেন, عَلَيْهَا تِسْعَةَ عَشَرَ ‘জাহান্নামের প্রহরী হ’ল ১৯ জন ফেরেশতা’ (মুদ্দাছছির ৭৪/৩০)। এই আয়াতকে তারা তাদের ১৯ তত্ত্বের পক্ষে ব্যবহার করেছেন। অথচ পরবর্তী আয়াতেই আল্লাহ বলে দিয়েছেন যে,

وَمَا جَعَلْنَا أَصْحَابَ النَّارِ إِلاَّ مَلاَئِكَةً وَمَا جَعَلْنَا عِدَّتَهُمْ إِلاَّ فِتْنَةً لِلَّذِيْنَ كَفَرُوْا لِيَسْتَيْقِنَ الَّذِيْنَ أُوْتُوْا الْكِتَابَ وَيَزْدَادَ الَّذِيْنَ آمَنُوْا إِيْمَانًا وَلاَ يَرْتَابَ الَّذِيْنَ أُوْتُوْا الْكِتَابَ وَالْمُؤْمِنُوْنَ وَلِيَقُوْلَ الَّذِيْنَ فِي قُلُوْبِهِمْ مَرَضٌ وَالْكَافِرُوْنَ مَاذَا أَرَادَ اللهُ بِهَذَا مَثَ

Like
1078
إعلان مُمول