যেভাবে গভীর হচ্ছে ইরান-রাশিয়া সম্পর্ক

0
4K

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও পশ্চিমের সঙ্গে ইরানের সম্ভাব্য পরমাণু চুক্তি নিয়ে চলমান আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে মস্কো-তেহরানের মধ্যকার সম্পর্ক নতুন করে সামনে এসেছে। আর দিনে দিনে এটি আরো গভীর হচ্ছে।

 

পরমাণু কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে দশকের পর দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমের নানা শত্রুতামূলক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার শিকার ইরান। যা এখন পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। ঠিক একইভাবে সম্প্রতি ইউক্রেন যুদ্ধের পর নজিরবিহীন নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়েছে রাশিয়া। ‘অভিন্ন শত্রু’র এ শত্রুতাই ইরান ও রাশিয়ার মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলতে সহায়তা করছে।

ইরানের চাওয়া এমন একটি বহুপাক্ষিক বিশ্বব্যবস্থা, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের মোড়লিপনা থাকবে না। একই লক্ষ্য রাশিয়ারও। তাদের এ অভিন্ন চাওয়াই একে অপরের কাছাকাছি আসতে উভয় পক্ষের জন্য নির্ণায়ক ভূমিকা রেখেছে। বর্তমানে অর্থনীতি ও বাণিজ্য থেকে শুরু করে সামরিক ও নিরাপত্তা - সবক্ষেত্রে তেরহান-মস্কো সম্পর্ক আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি গভীর।
           
ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে ইরান ও রাশিয়ার সম্পর্কের যে উন্নতি তা এক কথায় বিস্ময়কর। একে অপরকে সহযোগিতাই এ সম্পর্কের ভিত্তি, যা গড়ে উঠেছে নজিরবিহীন কূটনীতির মধ্যদিয়ে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এখন পর্যন্ত যেসব দেশ সফর করেছেন তার মধ্যে প্রথমেই রয়েছে ইরান।

রাষ্ট্রীয় ওই সফরে ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির পাশাপাশি দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির সঙ্গেও বৈঠক করেন তিনি। এরপর যতই দিন গড়িয়েছে কূটনীতির মাত্রা ততই বেড়েছে। আর এর মধ্যদিয়ে প্রতিনিয়তই বন্ধুত্বের নতুন নতুন সোপান ভাঙছে দুই পক্ষ।  

প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে প্রথমবারের মতো ইরানের একটি স্যাটেলাইট কক্ষপথে প্রতিস্থাপন করতে সাহায্য করেছে রাশিয়া। বিপরীতে ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য নিজেদের তৈরি বিশ্বের সর্বাধুনিক ড্রোন প্রযুক্তি মস্কোকে সরবরাহ করেছে তেহরান। শুধু তাই নয়, দুই পক্ষের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্কও চাঙ্গা হয়েছে। 

ইরান-রাশিয়া সম্পর্কের ইতিহাস

সাবেক দুই সাম্রাজ্য ইরান ও রাশিয়ার সম্পর্ক হাজার বছরেরও বেশি পুরনো। ভৌগোলিক নৈকট্যের কারণে শত শত বছর ধরে উভয়ের সম্পর্ক তিক্ত-মধুর অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে এগিয়েছে। এক সময় শাহ-শাসিত পারস্য (ইরান) ও জার-শাসিত রুশ সাম্রাজ্য একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল।
উভয়ের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ‍উঠে ১৫২১ সালে। মস্কোর গ্রান্ড ডাচি ও পারস্য সাম্রাজ্যের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কও তৈরি হয়; যা ১৯ শতকের শেষ পর্যন্ত ইতিবাচকভাবেই টিকে ছিল। এরপর রাশিয়া ও ব্রিটেন মিলে ইরানের ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণে হাত বাড়ালে সম্পর্ক তিক্ত হতে থাকে।

১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লবের মধ্যদিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের আরও বিস্তার ঘটে যাতে মধ্য এশিয়ার আজারবাইজানও অন্তর্ভুক্ত হয়। পরবর্তী কয়েক দশক ধরে যেখানে ইরান ও সোভিয়েত ইউনিয়ন (ইউএসএসআর) নিজেদের সীমানা ভাগাভাগি করেছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’কালে সোভিয়েত ইউনিয়ন (ইউএসএসআর) ও ইরানের সম্পর্ক ছিল অনেকটা অস্পষ্ট। রাজনৈতিকভাবে শাহ শাসিত ইরান ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমাপন্থি। কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে ইরান ও মস্কোর মধ্যে শক্তিশালী বাণিজ্য সম্পর্ক বজায় ছিল।   

১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন শাহ শাসিত প্রতিবেশী ইরানে কলকারখানা ও গ্যাসের পাইপলাইন তৈরিতে সহায়তা করে। সে সময় তারা ইরানের সামরিক বাহিনীকে আধুনিক অস্ত্রও দেয়। এমনকি ইরানের বুশেহরে পরমাণু চুল্লিও বসায় মস্কো। অর্থাৎ ইরানের পরমাণু কর্মসূচির দৃশ্যমান যাত্রা শুরু হয় রাশিয়ার হাত ধরে। বিশ্লেষকদের মতে, সেই ২ দশক ছিল মস্কো-তেহরান সম্পর্কের 'স্বর্ণযুগ’।

১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লবকে স্বাগত জানান সোভিয়েত নেতা মিখাইল ব্রেজনেভ। কিন্তু ইরাক-ইরান যুদ্ধে ইরাককে সমর্থন করে ইউএসএসআর। এরপর আফগানিস্তান থেকে রুশ সেনা প্রত্যাহারের পর উভয় পক্ষের সম্পর্কে ফের উন্নতি ঘটে। 

সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর দুই প্রতিবেশী দেশ মোটাদাগে আন্তরিক সম্পর্ক উপভোগ করেছে। একে অপরের কৌশলগত মিত্র হয়ে উঠে ইরান ও রাশিয়া। আর্মেনিয়ার পাশাপাশি ককেশাস অঞ্চলে একটি অক্ষও গড়ে তোলে তারা।

২০১১ সালে 'আরব বসন্ত'র দমকা বাতাস দামেস্কে আঘাত হানলে পরিস্থিতি হঠাৎ পাল্টাতে শুরু করে। ইরান শুরুতে আরব দেশগুলোর স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে গণজাগরণকে স্বাগত জানালেও গণতন্ত্রপন্থিরা যখন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন তখন তেহরান বাশারের পাশে দাঁড়ায়। বাশারের পতন ঠেকাতে সহযোগিতার হাত বাড়ায় রাশিয়াও। সিরিয়ার মাটিতে রাশিয়া-ইরানের বন্ধুত্বের নতুন অধ্যায় শুরু হয়।

ইরান-রাশিয়া কূটনৈতিক সম্পর্ক

একে অপরের সম্পর্ক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ইরান ও রাশিয়া নিজেদেরকে ‘বৈষয়িক সুবিধার অংশীদার’ হিসেবে অভিহিত করে। বিশেষ করে ‘অভিন্ন শত্রু’ পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে যখন সম্পর্ক চাপের মুখে তখন দেশ দুটি ক্রমেই কাছাকাছি হয়েছে। যা রাশিয়া ও ইরানের নেতাদের বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে। দুই দেশই বলেছে, পশ্চিমাদের চাপই তাদেরকে কাছাকাছি এনেছে।
চলতি বছরের শুরুর দিকে (জানুয়ারি মাসে) রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের আমন্ত্রণে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে মস্কো যান ইরানি প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি। ক্ষমতা গ্রহণের পর এটিই ছিল ইরানি প্রেসিডেন্টের প্রথম রাশিয়া সফর। সফরকালে পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করেন রাইসি। বলেন, ‘রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক বাড়ানো ও উন্নয়নে আমাদের কোনো সীমা নেই।’
এর এক মাস পরই ইউক্রেন অভিযান শুরু করে রাশিয়া। ইউক্রেন অভিযানের চার মাস পর পুতিন-খামেনি বৈঠকটি ছিল আরও তাৎপর্যপূর্ণ। একই সঙ্গে এটা পশ্চিমা বিশ্বের জন্যও ছিল গুরুত্বপূর্ণ বার্তা। ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত আন্তর্জাতিক পরমাণু চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করতে নতুন করে শুরু হওয়া আলোচনা নিয়ে ইরান যখন পশ্চিমা বিশ্বের চাপের মুখে, ঠিক তখন তেহরান সফর করেন পুতিন।

পুতিনের এ সফর তেহরানের জন্য ছিল সোনায় সোহাগা। কারণ এর মধ্যদিয়ে ইরান পশ্চিমা বিশ্বকে বার্তা দিতে সমর্থ হয় যে, তাদের হাতে অন্য অপশনও রয়েছে। তারা পশ্চিমের সঙ্গে চুক্তি করতে বাধ্য নয়। পুতিন-খামেনির ওই বৈঠকের পর থেকে তেহরান-মস্কো জোর কূটনীতি অব্যাহত রয়েছে।

বাণিজ্য সম্পর্ক

শুধু কূটনীতি নয়, নিজেদের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্কও বাড়াচ্ছে ইরান ও রাশিয়া। চলতি মাসেই দেশ দুটির মধ্যে একটি জ্বালানি চুক্তি হয়েছে। চুক্তির অধীনে ইরানের তেলখাতে সাড়ে ৬শ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে রাশিয়া।

গত সপ্তাহেই ইরানের জ্বালানিমন্ত্রী জাভেদ আউজি চুক্তির বিষয়টি ঘোষণা করেন। গত জুলাই মাসে ইরানি ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি ও রাশিয়ার গ্যাজপ্রম ইরানে দুটি গ্যাসক্ষেত্র ও ছয়টি তেলের খনি উন্নয়নের কাজে সহযোগিতা করার জন্য একমত হয়।

এখানেই শেষ নয়, রাশিয়ার গ্যাজপ্রমের সঙ্গে ৪০ বিলিয়ন তথা চার হাজার ডলারের একটি জ্বালানি চুক্তি সইয়ের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে ইরান। চলতি বছরের ডিসেম্বরেই চুক্তি চূড়ান্ত হবে বলে আশা করছেন ইরানি কর্মকর্তারা। এ ব্যাপারে ইরানের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহদি সাফারি বলেন, 'আমরা গ্যাজপ্রমের সঙ্গে ৬শ ৫০ কোটি ডলারের একটি চুক্তি চূড়ান্ত করেছি। আশা করছি, ৪ হাজার কোটি ডলারের অবশিষ্ট চুক্তি আগামী মাসে স্বাক্ষরিত হবে। বর্তমানে এ নিয়ে আলোচনা চলছে।'

সামরিক সহযোগিতা

ইরান ও রাশিয়ার সামরিক সহযোগিতার শুরু মূলত সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের সময়। ২০১১ সালে সিরীয় প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে উৎখাতের পশ্চিমা চেষ্টা রুখতে সামরিক সহায়তা দেয় তেহরান। ২০১৫ সালে আসাদ যখন কোণঠাসা তখন সিরিয়ার যুদ্ধে যোগ দেয় মস্কো। রুশ বিমান হামলায় যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। পতনের হাত থেকে রক্ষা পান আসাদ।

মধ্যপ্রাচ্যে মিত্রদের সহায়তার পাশাপাশি ইরান এখন তার সামরিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধেও। রাশিয়াকে নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি অস্ত্রশস্ত্রের পাশাপাশি আইআরজিসির সামরিক উপদেষ্টা পাঠিয়েছে তেহরান। এর মধ্যে ‘কামিকাজে সুইসাইড ড্রোন’ নামে ইরানের তৈরি অত্যাধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করে ইউক্রেনে হামলা চালাচ্ছে রুশ বাহিনী।
Like
1K
Site içinde arama yapın
Kategoriler
Read More
Shopping
Spider x Corteiz Collab: Fusing Bold Style with Streetwear Edge
The fashion world is no stranger to collaborations, but every so often, a partnership comes along...
By Stussy Apperal 2024-10-31 06:19:45 0 1K
Shopping
Dior Outlet In case you hadn't heard
When Kim diorsshoessale.com West found a pair of vintage python pants from Tom Ford's spring 2000...
By Josephine Flores 2024-05-11 06:47:12 0 5K
Shopping
How to Find the Best Deals on Essentials Sweatpants
Essentials sweatpants are a popular choice for those who value comfort and style, making them a...
By Stussy Apperal 2024-11-01 14:58:30 0 2K
Uncategorized
ধানের তুষে সিলিকা
ধান ভাঙানোর পর আলাদা হয়ে যায় চাল ও তুষ। সেই তুষ পুড়িয়ে উৎপাদন হচ্ছে বায়োগ্যাস, তাতে চলছে...
By Prothom Alo 2022-11-27 15:31:35 1 3K
Shopping
Which One To Choose Closure Or Frontal
If you consider wearing a wig on vacation, such as the beach or rainforest, or if you plan to...
By Mslynnhair Mslynnhair 2022-11-23 07:36:40 0 3K