মুটিয়ে যাওয়া এখন উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে মোটামুটি জাতীয় সমস্যা। এই হার বাড়ছে অবিশ্বাস্য গতিতে। পাশাপাশি ওজন কমানোর জন্য নানা ধরণের টিপস ঘুরছে চারপাশে। কিটো ডায়েট, লো কার্ব ডায়েট, ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং, ফাস্টিং, সারাদিনে একটা মিল, হাঁটা, ব্যায়াম, জিম…সহ নানা ধরনের ব্যাপারস্যাপার। 

অনেকে শুরু করছেন, বছরে কয়েকবার শুরু করছেন কিন্তু ধরে রাখতে পারছেন না। একবার ওজন কমাচ্ছেন, আবারও বেড়ে যাচ্ছে হু হু করে। যেন বা বাতাস খেলেই ওজন বাড়ে। নির্দিষ্ট আকারে শরীরের মাপ ধরে রাখা যেন দুঃসাধ্য নয় রীতিমত অসাধ্য বিষয়। 

অথচ এই গ্রহেই জাপান নামক দেশটির মানুষ খুব স্বাভাবিকভাবেই চিকন স্বাস্থ্যের অধিকারী। কোনো বাড়তি চাপ নিয়ে নয়, ডায়েট কন্ট্রোল বা খাদ্য নিয়ন্ত্রণ করে নয়, আরোপিত ব্যায়াম বা অধিক হাঁটাহাঁটি করে নয়। 

তাহলে কি সেই জাদুর কাঠি বা কোন সেই পরশপাথর যার অভাবে বিশ্বের অন্য প্রান্তের মানুষ কাঙ্ক্ষিত ফিটনেস পাবার সংগ্রাম করে যাচ্ছে? আর বিজ্ঞানই বা কি বলে? 

বিশ্বের সবচে বেশি গড় আয়ুর দেশ কিংবা মেদযুক্ত মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে কম কোন দেশে? একটাই উত্তর জাপান। কি খায় তারা, নাকি না খেয়ে থাকে?

জাপান ও জাপানিদের সফলতা শুরু হয় খাবার থেকে। যেখানে কার্বোহাইড্রেট বা শর্করার পরিমাণ কিন্তু বেশিই থাকে। সবজি, মাছ, মাংস, শস্যের সাথে দুধের তৈরি খাবার এবং ফলমূল খায় অল্প পরিমাণে। বাড়তি লবণ ও চিনিযুক্ত খাবার সব সময়ই এড়িয়ে চলে তারা।  

সরকারের ঠিক করে দেয়া খাদ্যতালিকা মেনে চলে বেশিরভাগ জাপানিই। ফলে বাইরের তৈরি পিৎজ্জা, হটডগ বা ফ্রোজেন খাবারের চেয়ে বাড়ির তৈরি স্বাস্থ্যকর খাবারেই তাদের আগ্রহ বেশি। 

জেনে অবাক হবেন বিশ্বে জাপানেই জনপ্রতি সবচেয়ে বেশি ভেন্ডিং মেশিন রয়েছে। তবে সেগুলোতে স্ন্যাক্স থাকে না। কারণ জাপানিরা স্ন্যাক্স খায় না বললেই চলে। তিনবেলা পূর্ণ খাবারেই অটল তারা। অন্য সময় তেমন ক্ষুধা লাগে না বলে হুট করে এটাসেটা খাবার ক্রেভিংও জাগে না। তবে এর মধ্যে যদি কেউ স্ন্যাক্স খেতেই চায় তাহলে খায় খুবই অল্প পরিমাণে।

তাই বলে কি তারা ফাস্টফুড খায় না? আসলেই কম খায়। খুবই কম। টানটান শিডিউলের যত ব্যস্ততাই থাক বাড়িতে খাবার তৈরি বন্ধ থাকে না। তবে যারা একান্তই পারেন না, তারা বেছে নেন ফাস্ট ফুড, যেগুলো স্বাস্থ্যকর এবং বাড়িতে রান্নার মতই। 

আমেরিকান ফুড চেইন ম্যাকডোনাল্ডস, বার্গার কিং এবং পিৎজ্জা হাটের শাখা জাপানে রয়েছে, তবে তাদের মন পড়ে থাকে বাড়িতে রান্না করা পুষ্টিকর খাবারে। প্রাথমিক শিক্ষাতেই পুষ্টি নিয়ে জানতে পারে বাচ্চারা। বাড়িতে তৈরি খাবারের উপকারিতা আর ফাস্ট ফুডের ক্ষতির পাঠ সেখানেই গেঁথে যায় মনে। স্কুলের সবার সাথে বসে খাওয়া, খাবার খেতে তাড়াহুড়া নয়, আরাম করে পুরোটা শেষ করা, এমন অভ্যাস নিয়েই বড় হয় শিশুরা। 

সময়মত খাওয়া তাদের অভ্যাস। তাই রুটিন ঠিক রাখতে  আগে থেকেই পরের দিনের বা পরের বেলার খাবার তৈরি রাখতে হয়। এতে করে প্রচণ্ড ক্ষুধার সময় এটাসেটা খাবার পছন্দ করার ভুলটা তাদের হয় না৷

বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব একটু বেশি হওয়ায় শিশু বয়স থেকেই হাঁটা বা সাইকেলে চলার অভ্যাস তৈরি হয় জাপানিদের। তাই দরকার হয় না বাড়তি ব্যায়ামের। 

জানেন তো, অল্প পরিমাণে খাবার পাতে নেয়ার সাথে কম খাবার খাওয়ার ঘনিষ্ঠ যোগ রয়েছে! সেটাই করে জাপানিরা, সব ধরনের খাবারই পাতে নেয়, তবে খুব কম পরিমাণে। এ জন্য তাদের প্লেটের আকারও ছোট। আর অল্প অল্প করে থাকে অনেক আইটেম।

দারুণ একটি ব্যাপার হলো দেশটির গণপরিবহন ব্যবস্থা তাদের জীবনযাত্রার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাদের গণপরিবহন ব্যবস্থা জনবান্ধব। বাইসাইকেল চালানোর জন্য আলাদা লেন এবং হাঁটার জন্য নিরাপদ ফুটপাত আছে। বাড়তি ক্যালোরি এভাবেই ঝরে যায়।  

চা, জাপানিদের চা মানেই গ্রিন টি বা সবুজ চা। এটিই জাপানের সবচেয়ে বেশি পান করা পানীয়। অনেক জাপানিই দিনে এক কাপ গ্রিনটি পান করেন, আবার অনেকে কয়েক কাপ। অনেক হোটেলই খাবার আগে বা পরে বিনামূল্যে গ্রিনটি দেয়। তারা বলে খাবার আগে এই চা বাড়তি খাওয়া রোধ করে। পানি আর চা পাতার সমন্বয়ে বানানো এই গ্রিনটিতে কোনো ক্যালরি নেই। 

জাপানিদের চপস্টিক দিয়ে খাওয়া দেখে অনেকেই অবাক হন। মজার ব্যাপার হলো এই চপস্টিকই তাদেরকে অল্প অল্প করে সময় নিয়ে খাবারের অনুশীলনে রাখে। 

এই সময়টাতে মানুষ খাবারের স্বাদ পুরোপুরি নিতে পারে, খাবারের সাথে একাত্মতা বোধ করে, ঠিক কখন পেট ভরলো সেটাও বুঝতে পারে। জাপানিরা জানে ধীরে খেলে শরীরের উপকার হয়। শান্তি প্রিয় জাপানিদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তাদের শরীরে কি প্রবেশ করছে সেটা।