মহাবিশ্বের শেষ প্রান্তে

0
3K

বছর দশেক বছর আগে জ্যোতির্বিদেরা হাবল টেলিস্কোপের তথ্য ব্যবহার করে মহাশূন্যের সবচেয়ে দূরের দৃশ্যমান গ্যালাক্সিটির খোঁজ করছিলেন। এই খোঁজার পর্যায়ে তাঁরা দ্রুতই একে অপরের রেকর্ড ভাঙছিলেন। দূরবর্তী গ্যালাক্সিগুলোর দূরত্ব নির্ধারণ একটি কঠিন কাজ এবং বিভিন্ন গবেষক দলের গবেষণার ফলাফলও কিছুটা ভিন্ন ভিন্ন হয়। এই প্রতিযোগিতায় 2012 সালে আবিষ্কৃত MACS0647-JD গ্যালাক্সিটি এখন পর্যন্ত টিঁকে রয়েছে। MACS0647-JD গ্যালাক্সিটির লাল সরণ নির্ধারণ করা হয়েছে ১০.৩। যার অর্থ একটি ‘সমতল’ মহাবিশ্বে এই গ্যালাক্সি থেকে যে আলো আমরা এ বছর অবলোকন করছি, তা প্রায় ১৩.৩ বিলিয়ন (বা এক হাজার তিন শ তিরিশ কোটি) বছর আগে রওনা দিয়েছিল। এর অর্থ এই নয়, এই গ্যালাক্সির দূরত্ব ১৩.৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষ। কারণ যে আলো আমরা আজ দেখছি, সেটা বিকিরণের সময় এই গ্যালাক্সি ‘আমাদের’ অনেক কাছে ছিল (যদিও পৃথিবীর তখন জন্ম হয়নি)। পাশাপাশি ‘এই মুহূর্তে’ সেটার দূরত্ব ১৩.৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষের অনেক বেশি হবে। স্থানের (বা দেশের) প্রসারণের জন্য মহাকাশবিদ্যায় দূরবর্তী গ্যালাক্সিদের দূরত্ব নির্ধারণ করা তুলনামূলকভাবে জটিল এবং একটি ‘সমতল’ মহাবিশ্বে এই গ্যালাক্সির ‘বর্তমান’ দূরত্ব ৩২ বিলিয়ন আলোকবর্ষের কাছাকাছি।

কেন এই গ্যালাক্সির দূরত্ব ১৩.৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষ নয়?

প্রথমত, যখন ওই গ্যালাক্সি থেকে আলো রওনা দিয়েছিল তখন সেই গ্যালাক্সি ও আমাদের ছায়াপথ গ্যালাক্সির মধ্যে দূরত্ব ছিল ৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষের মতো। এটা কীভাবে আমরা গণনা করছি, সেটা পরে বলছি। সেই গ্যালাক্সি থেকে আলোর কণিকারা যত পৃথিবীর দিকে আসবে, মাঝখানের স্থানের প্রসারণ ক্রমাগত হতেই থাকবে। কাজেই আলোকে সেই সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে সাঁতরাতে হবে।

আমি একটা নদী সাঁতরে পার হতে চাই, কিন্তু সাঁতরানোর সময় দেখি ওই পাড় আমার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, পেছন ফিরে দেখি যে পাড় থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম, সেই পাড়ও দূরে চলে যাচ্ছে। তাই ফোটনদের ৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষের বদলে ১৩.৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষ লাগবে আমাদের কাছে পৌঁছাতে। তত দিনে উৎসের গ্যালাক্সিটি দূরে সরে গিয়ে পৃথিবী থেকে ৩২ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে অবস্থান করবে। আমাদের দুরবিনে সেই গ্যালাক্সির যে আলো দেখছি, সেটা ১৩.৩ বিলিয়ন বছর আগে গ্যালাক্সিটির কী অবস্থা ছিল, তা-ই দেখাচ্ছে। স্থানের স্ফীতির ফলে এর মধ্যে আবার ফোটনেরও তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেড়ে গেছে, যার ফলে তার রেড শিফট বা লাল সরণ হয়েছে। অতিবেগুনি তরঙ্গে যে ফোটনের সৃষ্টি হয়েছিল, স্থান সম্প্রসারণের ফলে তাকে অবলোহিত তরঙ্গে দেখছি।

MACS0647-JD গ্যালাক্সির লাল সরণ বা z হচ্ছে 10.3। কাজেই সেই গ্যালাক্সির যে আলো আমরা আজ দেখছি, সেটা সেই গ্যালাক্সি থেকে যখন বেরিয়েছে, তখন মহাবিশ্বের ব্যাস আজ থেকে 10.3 + 1 = 11.3 গুণ ছোট ছিল। এই সমীকরণটা হলো, 1+z = a0(t)/ ae(t)

এখানে z হচ্ছে রেড শিফট বা লাল সরণ। a0(t) এবং ae(t) হচ্ছে স্কেল ফ্যাক্টর। সময়ের বা t-এর সঙ্গে মহাবিশ্ব কেমনভাবে বাড়ে, সেটাই এই স্কেল ফ্যাক্টরের বিবেচ্য বিষয়। এক অর্থে স্কেল ফ্যাক্টর মহাবিশ্বের ব্যাস বা ব্যাসার্ধের সঙ্গে তুলনীয়, যদিও সেটা ঠিক মহাবিশ্বের ব্যাস বা ব্যসার্ধ নয়। সাধারণীকরণ করে আমরা বলতে পারি, আলো বিকিরণের সময় মহাবিশ্বের স্কেল ফ্যাক্টর যদি হয় ae(t) এবং আমাদের দ্বারা সেই আলো অবলোকনের সময় স্কেল ফ্যাক্টর যদি হয় a0(t) তবে মহাবিশ্ব অন্তর্বর্তী সময়ে a0(t)/ae(t) বেড়েছে। এই ক্ষেত্রে মহাবিশ্ব a0(t) = ae(t)(1+ z) = ae(t)(1 + 10.3) বা 11.3 গুণ বেড়েছে। বর্তমান সময়ে z= 0, তাই আমাদের সময়ে মহাবিশ্বের স্কেল ফ্যাক্টর হচ্ছে a0(t ) = 1।

এখন দেখা যাক z = 10.3–এর সময় মহাবিশ্ব আজকের থেকে কত ছোট ছিল। এই হিসাবটার জন্য আমাদের মহাবিশ্বের একটা মডেল ঠিক করতে হবে। এটার জন্য জ্যোতির্বিদেরা আইনস্টাইন সাধারণ আপেক্ষিকতা সমীকরণের ফ্রিডমান সমধান ব্যবহার করেন। মহাবিশ্বের মডেল বিভিন্ন প্যারামিটারের ওপর নির্ভর করে। আপাতত, আমরা চারটি প্যারামিটার ঠিক করি—লাল সরণ, হাবল ধ্রুবক, বস্তুর (কৃষ্ণ বস্তুসহ) পরিমাণ ও ডার্ক এনার্জি বা কৃষ্ণ শক্তির পরিমাণ। আমাদের মহাবিশ্বের দেশ-কালের মেট্রিক হবে সমতল, অর্থাৎ আলো এই মহাবিশ্বে স্থানীয় বিচ্যুতি বাদ দিলে মোটামুটিভাবে সরলরেখায় ভ্রমণ করবে। যদি হাবল ধ্রুবক ৬৮, বস্তুর পরিমাণ ২৭ শতাংশ ও কৃষ্ণ শক্তির পরিমাণ ৭৩ শতাংশ ধরা হয়, তবে এই মহাবিশ্বের বয়স হবে ১৩.৮ বিলিয়ন বছর।

এই মডেলে বিগ ব্যাংয়ের ৪৫৫ মিলিয়ন বছর পরে সেই সুদূর গ্যালাক্সি থেকে আলোর যাত্রা শুরু হয়। সেই গ্যালাক্সির ‘কো-মুভিং’ বা বর্তমান দূরত্ব হচ্ছে প্রায় ৩২ বিলিয়ন আলোকবর্ষ। তাহলে যে আলো আমরা আজ দেখছি, সেটা যখন গ্যালাক্সি থেকে বেরিয়েছিল তখন আমাদের আজকের অবস্থান ও সেই গ্যালাক্সির মধ্যে দূরত্ব ছিল ৩২/১১.৩ বা প্রায় ৩ বিলিয়ন আলোক বছরের মতো। সেই ৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষ ফুলে–ফেঁপে আজ ৩২ বিলিয়ন হয়েছে। এর মধ্যে মহাবিশ্বের ১৩.৩ বিলিয়ন বছর বয়স বেড়েছে।

আমরা কি তাহলে ওই গ্যালাক্সির থেকে দূরবর্তী কোনো বস্তু এর আগে অবলোকন করিনি? এর উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ! করেছি। দৃশ্যমান মহাবিশ্বের প্রায় শেষ প্রান্ত থেকে আসা আলো আমরা পর্যবেক্ষণ করেছি। সেই আলো গ্যালাক্সির মতো কোনো একক বস্তু থেকে আসছে না, সে আলো আসছে আমাদের চারপাশ ঘিরে মহাবিশ্বের যে আপাতসীমানা, সেখান থেকে। সেই আলো অবশ্য চোখে দেখা যায় না, তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য মাইক্রোওয়েভ এলাকায়। কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড বা সিএমবি (CMB বা অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণ) বহু কোটি বছর আগে ঘটিত বিগ ব্যাং বিস্ফোরণে সৃষ্ট শক্তির অবশেষ।

আমাদের দ্বারা নিরূপিত প্রতিটি CMB ফোটন দৃশ্যমান মহাবিশ্বের একদম শেষ প্রান্ত থেকে আসছে। বিগ ব্যাংয়ের পরে বস্তুর ঘনত্ব ধীরে ধীরে হালকা হয়ে আসছিল। কিন্তু তার মধ্যেও আলোর কণিকা বা ফোটন ইলেকট্রনের মেঘের মধ্যে আটকে পড়েছিল। বিগ ব্যাংয়ে সৃষ্ট ফোটন কণাগুলো ইলেকট্রনের সঙ্গে ক্রমাগত আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে নির্দিষ্ট জায়গার মধ্যে আবদ্ধ ছিল। যেহেতু সেই জায়গা থেকে কোনো ফোটনের বিকিরণ হয়নি, সেই অতি ঘন অঞ্চল আমাদের জন্য অস্বচ্ছ থেকে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে মহাবিশ্বের প্রসারণের ফলে তাপমাত্রা ঠান্ডা হয়ে এলে ইলেকট্রন প্রোটনের কক্ষপথে আবদ্ধ হয়ে সৃষ্টি করল হাইড্রোজেন পরমাণুর।

প্রথম প্রথম সিএমবি ফোটন সেই পরমাণুগুলোকে আয়নিত করতে গিয়ে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু পরে ফোটনের শক্তি কমে যাওয়াতে সেই নিউট্রাল পরমাণুগুলোকে সে আয়নিত করতে সক্ষম হলো না এবং সেই ফোটনগুলো ধ্বংস হলো না। যার ফলে বিগ ব্যাংয়ের প্রায় ৩,৮০,০০০ বছর পরে ফোটন মুক্ত হলো, সেই ফোটনই প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর পর আজ আমরা সিএমবি হিসেবে পর্যবেক্ষণ করছি। সেই ফোটন যখন বিকিরিত হয়েছিল, তখন মহাবিশ্বের ব্যাস আজ থেকে প্রায় এক হাজার গুণ ছোট ছিল। এর মধ্যে মহাবিশ্বের ক্রমাগত সম্প্রসারণের ফলে এই সিএমবি ফোটনের তাপমাত্রা তাদের আদি ৩০০০ কেলভিন থেকে ২.৭ কেলভিনে নেমে এসেছে। বলা যায় সিএমবির প্রতিটি ফোটন মহাশূন্যের শেষ প্রান্ত থেকে এসেছে। কিন্তু তারা মুক্তি পেয়েছে বিগ ব্যাংয়ের ৩ লাখ ৮০ হাজার বছর পরে। তার মানে যা–ই করি না কেন, আমরা সেই সাড়ে তিন লাখ বছরের অস্বচ্ছ ‘দেয়াল’ পার হতে পারব না। অর্থাৎ বিগ ব্যাংয়ের ৩ লাখ ৮০ হাজার বছরের মধ্যে কী হয়েছিল, তার কোনো সম্যক ছবি আমরা পাব না। যদিও নিউট্রিনো পটভূমি বলে একটা জিনিস আছে, যার সূত্রপাত হয়েছে বিগ ব্যাংয়ের প্রথম ১০ সেকেন্ডের মধ্যে। সেই আদি নিউট্রিনোর সন্ধান এখনো পাওয়া যায়নি। কিন্তু তারও আগে মহাবিশ্বের শুরুতে যদি অতিস্ফীতি (inflation) হয়ে থাকে তাতে সৃষ্ট মহাকর্ষীয় তরঙ্গের ছাপ রয়ে যাবে সিএমবিআর মানচিত্রে। বিজ্ঞানীরা তারও সন্ধান করে যাচ্ছেন।

এই দেয়াল কি সত্যি একটা কিছু? এর উত্তরটা মহাজাগতিক অনেক কিছুর মতোই একটু জটিল। প্রথমেই বলি, আলোর গতির (সেকেন্ডে ৩ লাখ কিলোমিটার) সীমাবদ্ধতার জন্যই এই দেয়ালের সৃষ্টি। আলোর গতি অসীম হলে আমরা মুহূর্তেই সমগ্র মহাবিশ্ব দেখে ফেলতাম। এমন কি সিএমবির এই অস্বচ্ছ দেয়ালও আমাদের জন্য বাধা হতো না। কারণ, এখনই সেখানে যেতে পারলে সেই দেয়াল থাকত না। যেমন আমরা যেখানে আছি, সেখানে কোনো দেয়াল নেই।

আমরা যদি কোনো অলৌকিক উপায়ে এখনই সেই দেয়ালে উপস্থিত হতে পারতাম, তাহলে আমরা হয়তো দেখতাম সেই দেয়ালের অবস্থানে অবস্থিত আমাদের মতোই এক গ্যালাক্সি, আমাদের চারপাশের সাধারণ যে রকম গ্যালাক্সি, সে রকম গ্যালাক্সিতে ভরপুর। আর সেখানে যদি আমাদের মতো বুদ্ধিমান প্রাণী থাকে, তারাও হয়তো দুরবিন লাগিয়ে আমাদের দেখছে। কিন্তু আমাদের গ্যালাক্সির বদলে তারা দেখছে সেই সিএমবি দেয়াল। তারা হয়তো কোনো দিনই জানবে না বর্তমানের ছায়াপথের কথা। এই মুহূর্তে ছায়াপথ তাদের কাছ থেকে আলোর গতিবেগের ঊর্ধ্বে দূরে সরে যাচ্ছে। CMB দেয়ালের লাল সরণ z হল 11.00, এই মুহূর্তে সেটি আমাদের থেকে প্রায় ৪৫ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। কিছু গণনা অনুযায়ী সেই দেয়াল আমাদের কাছ থেকে আলোর গতিবেগের বেশি গতিবেগে আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। কাজেই এই মুহূর্তে CMB দেয়াল থেকে যে বিকিরণ বের হচ্ছে, তা আমরা কখনোই দেখতে পাব না।

দৃশ্যমান মহাবিশ্ব হচ্ছে আমাদের পর্যবেক্ষণের আওতাধীন মহাবিশ্ব, শুধু গত ১৩.৮ বিলিয়ন বছরের মধ্যে যে আলো আমাদের উদ্দেশে রওনা দিয়েছে, সেই আলো অবলোকনের মাধ্যমে এই মহাবিশ্বের সীমানা রচিত। মহাবিশ্বের মধ্যে কোনো বিশেষ অবস্থান নেই, দর্শকেরা তাঁদের নিজস্ব দৃশ্যমান মহাবিশ্বের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছেন। সমগ্র মহাবিশ্ব কত বড়, সে সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণাই নেই। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, মনে হচ্ছে মহাবিশ্ব হয় অসীম, নইলে এতই বড়, যা অসীমেরই নামান্তর মাত্র। আমাদের দৃশ্যমান মহাবিশ্ব সমগ্র মহাবিশ্ব বলে যদি কিছু থাকে, তার একটা খুবই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশমাত্র।

Like
13
Site içinde arama yapın
Kategoriler
Read More
Networking
Creative Recruitment Strategies to Transform Your Talent Pool
Recruitment is more than just filling vacancies; it's about finding the right talent that aligns...
By Delta International 2024-09-27 12:01:11 0 4K
Shopping
after Bottega Veneta spending hours browsing pages upon pages
Outside of our own. something from I interned for them the summer after my freshman year of...
By Kelly Church 2024-11-20 07:56:31 0 1K
Shopping
Why Should You Buy A 360 Lace Front Wigs
You should have heard about 360 Lace Wig. It doesn't matter if you haven't heard about it....
By Mslynnhair Mslynnhair 2022-11-21 06:42:56 0 3K
Oyunlar
Valorant Episode 4 Act 3 To Come Out Soon; Battle Pass, Release Date And More
The Valorant Episode 4 Act 3 is coming out soon in your Valorant Accounts and players are...
By valorantigv accounts 2022-11-16 07:48:08 0 4K
Other
"Essential Hoodies: The Perfect Blend of Minimalism and Comfort"
The Essential Hoodie: A Timeless Wardrobe Staple for Every Occasion Hoodies have evolved from...
By Stussy Apperal 2024-11-14 09:02:10 0 3K