"আমার জন্মই হয়েছে জাহান্নামে। আমি মোটেও বাড়িয়ে
বলছি না কিন্তু। সাও পাউলোর যে বস্তিতে আমার জন্ম তার
নাম ইনফেরিনহো(ছোট জাহান্নাম)।
এলাকাটা ভীষণ কুখ্যাত ছিল মাদক ব্যবসার কারণে।
আমার বাড়ির চৌকাঠ থেকে দশ কদম দূরেই খুচরো মাদক
বিক্রেতারা হাতে হাতে মাদক বিক্রী করত ভোর থেকে রাত
অবধি। আর তাদের ক্রেতারাও ওখানে দাঁড়িয়েই খেত
সেগুলো।
বন্দুক পিস্তলকে ভয় পেতাম না আমরা। কারণ দেখতে
দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। ভয় পেতাম পুলিশকে।
একবার পুলিশ লাথি মেরে ঘরের দরজা ভেঙে ঢুকে
গিয়েছিল, কোন এক অপরাধীকে খুঁজছিল তারা।
ইনফেরিনহোর প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই এমন দরজা ভাঙা
পড়েছে।
লাশ দেখলে ভয় পেতাম না আমরা। কারণ দেখতে দেখতে
অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। আমার বয়স যখন ৮ তখন স্কুল
যাওয়ার পথে দেখলাম একজন আমাদের গলিতে মরে পরে
আছে। স্কুল তো যেতে হবে নাকি? আমি চোখ বন্ধ করে
লাশটা ডিঙিয়ে স্কুলে গেলাম। ছোট জাহান্নামের জীবন
এমনই ছিল।

জীবনে একমাত্র আনন্দ ছিল ফুটবল। বড় ভাইয়ের সাথে
বস্তির স্কয়ারে ফুটবল খেলতে যেতাম। একসময় সেটা
মাটির ছিল, পরে হল কংক্রিটের। খালি পায়ে কংক্রিটেই
ফুটবল খেলতাম, রক্তাক্ত পা নিয়ে প্রতিদিন বাড়িতে
ফিরতাম। ভাল জুতো কেনার পয়সা ছিল না আমাদের, আর
ছিল না স্কুল জুতো ছেঁড়ার সাহস।
ঐ স্কয়ারে সবাই খেলত - মাদক ব্যবসায়ী, ট্রাক ড্রাইভার,
নির্মাণ শ্রমিকেরা, পুলিশের দারোগারা। ফুটবল মাঠে সবাই
ছিল সমান। ড্রিবলিং ব্যাপারটা আমার মাঝে সহজাত ছিল।
ফুটবল পায়ে থাকলে মনে কোন ভয় কাজ করত না, কাউকে
পরোয়া করতাম না আমি, কেবল কাটাতাম সবাইকে।
ড্রাগডিলারদের ইলাস্টিকো মারতাম, দারোগাদের নাটমেগ
করতাম, ছিনতাইকারীদের রেইনবো ফ্লিক করতাম। বল
পায়ে থাকলে কিছুর তোয়াক্কা করতাম না।
বাড়িতে বাবা মার সাথে এক খাটে ঘুমাতাম, কারণ আমার
জন্য আলাদা খাট কেনার সামর্থ্য ছিল না তাদের। ঘুমের
মাঝে পাশ ফিরলেই বাবার সাথে ঠেকতো, ওপাশ ফিরলে
মার সাথে। আমার বয়স যখন ১১, তখন বাবা মা আলাদা
হয়ে গেলেন। খুব কঠিন সময় তখন। বাবা ভোর ৫টায়
কাজে বের হতেন, রাত ৮টায় ফিরতেন। তখনো বাবার সাথে
এক খাটেই ঘুমাতাম।
১৪ বছর বয়সে সাও পাউলো দলে ডাক পেলাম। কোচ
বলতেন, দেখ সবাই - খেলার দিন সবাইকে জয়ের জন্য
ক্ষুধার্ত থাকতে হবে। আমি মনে মনে বলতাম, কোচ আমি
আসলেই ক্ষুধার্ত, দুপুরে খাওয়া জোটে নি আমার।
১৮ বছর বয়সে যখন পলিস্তা কাপের ফাইনালে
করিন্থিয়ানসকে হারিয়ে আমরা চ্যাম্পিয়ন হলাম তখনো
আমি ঐ বস্তির বাড়িতেই থাকি, বাবার সাথে এক খাটে
ঘুমাই। বাড়িতে ফেরার সময় রাস্তায় অপরিচিত লোকজন
আমাকে ডাক দিত, হেই ম্যান তোমাকে তো একটু আগে
টিভিতে দেখেছি। এখানে কি?
আমি এখানে থাকি।
তারা বিশ্বাস করত না, হেসেই উড়িয়ে দিত।
গ্রেমিওর একজন প্লেয়ার একবার একটা লাল রেঞ্জ রোভার
নিয়ে মাঠে এল। আমি মাকে বললাম, এই গাড়িটা আমি
কিনব এক সময়।
মা বিশ্বাস করলেন না, হেসেই উড়িয়ে দিলেন।

এর এক বছরের মাথাতেই আমি আয়াক্সের হয়ে
চ্যাম্পিয়নস লিগ খেললাম। নিজের বাড়ি হল, নিজের খাট।
সেই লাল রেঞ্জ রোভার গাড়িটাও কিনে ফেললাম। মাকে
দেখালাম, কি বলেছিলাম না?
মা এবার হাসলেন না, কাঁদলেন। খুশির কান্না।

আমাদের ইন্টারনেটের পয়সা ছিল না। পাশের বাসার
তোমিওলো কাকুর ওয়াইফাই ব্যবহার করে ইউটিউবে
রোনালদিনহো, ক্রিশ্চিয়ানো, নেইমারদের ভিডিও দেখতাম
বারবার। এরা আমার কাছে ছিল ঈশ্বরের মত, ধরাছোঁয়ার
বাইরে। বস্তির জীবন থেকে তিন বছরের মাথাতেই আমি
এখন ম্যানচেস্টারে, থিয়েটার অফ ড্রিমসে ক্রিশ্চিয়ানোর
সাথে খেলছি। ব্রাজিলে ড্রেসিং রুম শেয়ার করছি নেইমারের
সাথে। অসম্ভব ব্যাপার তাই না? কিন্তু আমি তো বাস্তব
করতে পেরেছি।

মিডিয়ার লোকেরা আমাকে জিজ্ঞেস করে আমার স্বপ্নের
ব্যাপারে, আমি কি চাই? চ্যাম্পিয়নস লিগ? ব্যালন ডর?
বিশ্বকাপ?

না,এগুলো লক্ষ্য, স্বপ্ন নয়। আমার স্বপ্ন ছিল আমার মা
বাবাকে বস্তি থেকে বের করে আনা। সে জন্য জান দিতেও
প্রস্তুত ছিলাম আমি। সে স্বপ্ন আমি পূরণ করে ফেলেছি।

প্রতিবার যখন আমি মাঠে নামার আগে জুতোর ফিতে বাঁধি,
আমি নিজেকে মনে করিয়ে দেই আমি কোথা থেকে উঠে
এসেছি। বস্তি থেকে।
হ্যাঁ,আমি বস্তির ছেলে।।
আর আমার হাতের সিংহের ট্যাটুটা সেই সব ছেলেদের জন্য
যারা সেই জাহান্নাম থেকে বেরনোর চেষ্টা করছে।।

Translated & posted by Fuad Naser
"আমার জন্মই হয়েছে জাহান্নামে। আমি মোটেও বাড়িয়ে বলছি না কিন্তু। সাও পাউলোর যে বস্তিতে আমার জন্ম তার নাম ইনফেরিনহো(ছোট জাহান্নাম)। এলাকাটা ভীষণ কুখ্যাত ছিল মাদক ব্যবসার কারণে। আমার বাড়ির চৌকাঠ থেকে দশ কদম দূরেই খুচরো মাদক বিক্রেতারা হাতে হাতে মাদক বিক্রী করত ভোর থেকে রাত অবধি। আর তাদের ক্রেতারাও ওখানে দাঁড়িয়েই খেত সেগুলো। বন্দুক পিস্তলকে ভয় পেতাম না আমরা। কারণ দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। ভয় পেতাম পুলিশকে। একবার পুলিশ লাথি মেরে ঘরের দরজা ভেঙে ঢুকে গিয়েছিল, কোন এক অপরাধীকে খুঁজছিল তারা। ইনফেরিনহোর প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই এমন দরজা ভাঙা পড়েছে। লাশ দেখলে ভয় পেতাম না আমরা। কারণ দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। আমার বয়স যখন ৮ তখন স্কুল যাওয়ার পথে দেখলাম একজন আমাদের গলিতে মরে পরে আছে। স্কুল তো যেতে হবে নাকি? আমি চোখ বন্ধ করে লাশটা ডিঙিয়ে স্কুলে গেলাম। ছোট জাহান্নামের জীবন এমনই ছিল। জীবনে একমাত্র আনন্দ ছিল ফুটবল। বড় ভাইয়ের সাথে বস্তির স্কয়ারে ফুটবল খেলতে যেতাম। একসময় সেটা মাটির ছিল, পরে হল কংক্রিটের। খালি পায়ে কংক্রিটেই ফুটবল খেলতাম, রক্তাক্ত পা নিয়ে প্রতিদিন বাড়িতে ফিরতাম। ভাল জুতো কেনার পয়সা ছিল না আমাদের, আর ছিল না স্কুল জুতো ছেঁড়ার সাহস। ঐ স্কয়ারে সবাই খেলত - মাদক ব্যবসায়ী, ট্রাক ড্রাইভার, নির্মাণ শ্রমিকেরা, পুলিশের দারোগারা। ফুটবল মাঠে সবাই ছিল সমান। ড্রিবলিং ব্যাপারটা আমার মাঝে সহজাত ছিল। ফুটবল পায়ে থাকলে মনে কোন ভয় কাজ করত না, কাউকে পরোয়া করতাম না আমি, কেবল কাটাতাম সবাইকে। ড্রাগডিলারদের ইলাস্টিকো মারতাম, দারোগাদের নাটমেগ করতাম, ছিনতাইকারীদের রেইনবো ফ্লিক করতাম। বল পায়ে থাকলে কিছুর তোয়াক্কা করতাম না। বাড়িতে বাবা মার সাথে এক খাটে ঘুমাতাম, কারণ আমার জন্য আলাদা খাট কেনার সামর্থ্য ছিল না তাদের। ঘুমের মাঝে পাশ ফিরলেই বাবার সাথে ঠেকতো, ওপাশ ফিরলে মার সাথে। আমার বয়স যখন ১১, তখন বাবা মা আলাদা হয়ে গেলেন। খুব কঠিন সময় তখন। বাবা ভোর ৫টায় কাজে বের হতেন, রাত ৮টায় ফিরতেন। তখনো বাবার সাথে এক খাটেই ঘুমাতাম। ১৪ বছর বয়সে সাও পাউলো দলে ডাক পেলাম। কোচ বলতেন, দেখ সবাই - খেলার দিন সবাইকে জয়ের জন্য ক্ষুধার্ত থাকতে হবে। আমি মনে মনে বলতাম, কোচ আমি আসলেই ক্ষুধার্ত, দুপুরে খাওয়া জোটে নি আমার। ১৮ বছর বয়সে যখন পলিস্তা কাপের ফাইনালে করিন্থিয়ানসকে হারিয়ে আমরা চ্যাম্পিয়ন হলাম তখনো আমি ঐ বস্তির বাড়িতেই থাকি, বাবার সাথে এক খাটে ঘুমাই। বাড়িতে ফেরার সময় রাস্তায় অপরিচিত লোকজন আমাকে ডাক দিত, হেই ম্যান তোমাকে তো একটু আগে টিভিতে দেখেছি। এখানে কি? আমি এখানে থাকি। তারা বিশ্বাস করত না, হেসেই উড়িয়ে দিত। গ্রেমিওর একজন প্লেয়ার একবার একটা লাল রেঞ্জ রোভার নিয়ে মাঠে এল। আমি মাকে বললাম, এই গাড়িটা আমি কিনব এক সময়। মা বিশ্বাস করলেন না, হেসেই উড়িয়ে দিলেন। এর এক বছরের মাথাতেই আমি আয়াক্সের হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ খেললাম। নিজের বাড়ি হল, নিজের খাট। সেই লাল রেঞ্জ রোভার গাড়িটাও কিনে ফেললাম। মাকে দেখালাম, কি বলেছিলাম না? মা এবার হাসলেন না, কাঁদলেন। খুশির কান্না। আমাদের ইন্টারনেটের পয়সা ছিল না। পাশের বাসার তোমিওলো কাকুর ওয়াইফাই ব্যবহার করে ইউটিউবে রোনালদিনহো, ক্রিশ্চিয়ানো, নেইমারদের ভিডিও দেখতাম বারবার। এরা আমার কাছে ছিল ঈশ্বরের মত, ধরাছোঁয়ার বাইরে। বস্তির জীবন থেকে তিন বছরের মাথাতেই আমি এখন ম্যানচেস্টারে, থিয়েটার অফ ড্রিমসে ক্রিশ্চিয়ানোর সাথে খেলছি। ব্রাজিলে ড্রেসিং রুম শেয়ার করছি নেইমারের সাথে। অসম্ভব ব্যাপার তাই না? কিন্তু আমি তো বাস্তব করতে পেরেছি। মিডিয়ার লোকেরা আমাকে জিজ্ঞেস করে আমার স্বপ্নের ব্যাপারে, আমি কি চাই? চ্যাম্পিয়নস লিগ? ব্যালন ডর? বিশ্বকাপ? না,এগুলো লক্ষ্য, স্বপ্ন নয়। আমার স্বপ্ন ছিল আমার মা বাবাকে বস্তি থেকে বের করে আনা। সে জন্য জান দিতেও প্রস্তুত ছিলাম আমি। সে স্বপ্ন আমি পূরণ করে ফেলেছি। প্রতিবার যখন আমি মাঠে নামার আগে জুতোর ফিতে বাঁধি, আমি নিজেকে মনে করিয়ে দেই আমি কোথা থেকে উঠে এসেছি। বস্তি থেকে। হ্যাঁ,আমি বস্তির ছেলে।। আর আমার হাতের সিংহের ট্যাটুটা সেই সব ছেলেদের জন্য যারা সেই জাহান্নাম থেকে বেরনোর চেষ্টা করছে।। ©️Translated & posted by Fuad Naser
Like
2
0 Yorumlar 0 hisse senetleri 42 Views 0 önizleme