টাটা মোটরসের কেস স্টাডি

0
5K

গল্পের শুরুটা হয় ১৯৯৮ সালে। ভারতের বোম্বাই হাউজে!

 

টাটা মোটরস এর পেসেঞ্জার গাড়ির ডিভিশন “টাটা ইন্ডিকা” তখন বেশ সংকটে। 

 

এটা ছিলো রতন টাটার খুবই উচ্চাকাংখী একটা প্রজেক্ট। তিনি চেয়েছিলেন, তার কোম্পানি ভারতের প্রথম ডিজেল ইঞ্জিনচালিত হ্যাচব্যাক উৎপাদন করবে। 

 

এবং প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করেছিলেন তিনি এই প্রজেক্টে! রতন টাটার স্বপ্ন ছিলো, ইন্ডিকা একদিন পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত কার ব্র্যান্ডগুলোর একটি হবে।

 

কিন্তু টাটা মোটর্সের দীর্ঘদিনের স্বপ্নের প্রকল্প “টাটা ইন্ডিকা” টানা ১ বছর চেষ্টার পরেও আশানুরূপ সাফল্যের মুখ না দেখায় একে বিক্রি করে দেবার সিদ্ধান্ত নেন রতন টাকা। বিস্তর টাকা লস করেছিলো সে এই খাতে! লসের অংক আরো বাড়ার আগেই বিক্রি করে দেয়া হোক!

 

তার এনালিষ্টরা ফোর্ডের নাম প্রস্তাব করলো, ফোর্ড তখন বেশ ভালো ব্যবসা করছিলো, তাই ভাবা হলো, তারা হয়তো ইন্ডিকার পুরো প্রডাকশন লাইন কিনতে আগ্রহী হবে। 

 

তাই তাদেরকে আমন্ত্রন জানানো হলে টাটা মোটরসের হেড কোয়ার্টার “বোম্বে হাউসে”, এটি মুম্বাইতে অবস্থিত। 

 

তো ফোর্ডের লোকজন টাটা ইন্ডিকার কারখানা ও প্রডাকশন লাইন দেখে সন্তুষ্ট হয়ে ফিরে গেলো। তবে জানালো, ফাইনাল মিটিং হবে ফোর্ডের আমেরিকান হেড অফিসে। সেখানেই তারা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবে। 

 

তো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানতে রতন টাটা ও তাঁর প্রতিনিধিদল যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে যান, যেখানে বিল ফোর্ডের সাথে রতন টাটার আলোচনা হয়। 

 

বিল ফোর্ড ছিলো তৎকালীন ফোর্ড কোম্পানির চেয়ারম্যান। আর এই লোক হচ্ছে ফোর্ড কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা হেনরি ফোর্ডের আপন নাতি। 

 

এবং সে ছিলো হোয়াইট সুপ্রিমিষ্ট, মানে নিজের সাদা চামড়া নিয়ে তার গর্বের কোনো শেষ ছিলো না! সোজা কথায়, চরম রেসিষ্ট ছিলো সে।

 

সেই বৈঠকে পদে পদে বিল ফোর্ড ভীষন অপমান করেছিলো রতন টাটা কে!

 

খুবই বিরক্ত হয়ে তাকে বলা হলো - “ আরে, তুমি তো প্যাসেঞ্জার কারের ব্যাপারে কিছুই জানো না, তো কি দরকার ছিলো এটা চালু করা? এখন তো লস খেয়ে আমাদের কাছে বেচতে এসেছো!” 

 

টানা তিন ঘন্টা ধরে সেই মিটিং চলেছিলো। প্রথমে বিল কিনতেই চায়নি, লস প্রজেক্ট কিনে লাভ কি, রতন টাটার সামনেই সে এসব বলছিলো। তার চোখে মুখে ছিলো স্পষ্ট বিরক্তি, আর ভীষন অহংকার!

 

শেষে বিল ফোর্ড রাজী হলো, এরপর রতনকে সে আবারো অপমান করতে বল্ল যে টাটা মোটরস কিনে টাটা গ্রুপকে আসলে দয়া করছে ফোর্ড।

 

অথচ এত অপমানের পরেও রতন টাটা মিটিংয়ে তেমন কিছুই বল্লেন না, সব মুখ বুজে সহ্য করলেন! 

 

কিন্তু বিল ফোর্ডের আচরণে সে মনে মনে তীব্র অপমানিত ও ক্রুদ্ধ হন। যার ফলে তিনি তার কোম্পানির একটা অংশকে ফোর্ডের কাছে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত বাতিল করে দেন। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, টাটা গ্রুপের এই গাড়ির সেক্টরটি তিনি বিক্রি করবেন না। 

 

এই ডিলটি যে তদারকি করছিলো, সেটা ছিলো একটা বিখ্যাত ফিন্যান্স কোম্পানি, রতন টাটা তাদের জানিয়ে দিলো তার সিদ্ধান্তের কথা। তারা বুঝলো, টাটা অপমানিত হয়েছে সুতরাং ফোর্ডের কাছে বিক্রি করবে না, হয়তো অন্য কারো কাছে করবে। 

 

তাই তারা রতন টাটাকে জিগেস করলো, অন্য কোনো কাষ্টমার দেখবে কিনা। টাটা তাদের সাফ জানিয়ে দিলেন - আর কারো কাছেই বিক্রি করবেন না!

 

রতন টাটা ভেবেছিলো, ফোর্ডের সাথে মিটিং শেষ করে সে আমেরিকাতে আরো কয়েকটা বিজনেস মিটিংয়ে যাবে, কিন্তু এই তিক্ত ঘটনার পর সে সব মিটিং ক্যানসেল করে দ্রুতই ভারত ফিরে যায়। এবং নিউইর্য়কে ফেরার ফ্লাইটে সে অস্বাভাবিক রকমের চুপচাপ আর শান্ত ছিলো! মানে অপমানের শক হজম করতে সে সময় নিচ্ছে!

 

জনশ্রুতি আছে, ভারতে ল্যান্ড করার পর তিনি তার বাসাতেও যান নাই, সোজা চলে যান বোম্বে হাউসে, ইন্ডিকার কারখানায়। 

 

এবং এরপর টাটা ইন্ডিকার সাথে যা ঘটে, তা পৃথিবীর অটোমোটিভ ইতিহাসে ধৈর্য্য, অধ্যবসায় আর জেদের এক অনন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে আজীবন! 

 

রতন টাটার ক্রমাগত চেষ্টায় কয়েক বছরের মাঝেই এক কালের ব্যর্থ ইন্ডিকা বেশ শক্ত অবস্থানে পৌঁছে যায়। ভারতের রাস্তায় রাস্তায় দেখা যায় টাটা ইন্ডিকাকে! 

 

শুধু তাই না, ইন্ডিকা আন্তজার্তিক বাজারেও রপ্তানি হতে শুরু করে! দামে সস্তা বলে এবং মান দামের তুলনায় ভালো বলে অটোমোবাইলের মতো কম্পিটিটিভি মার্কেটেও দ্রুতই ইন্ডিকা জনপ্রিয়তা পাওয়া শুরু করে!

 

ওদিকে টাটার সাথে মিটিং করার কয়েক মাস পরেই বিল ফোর্ড কোম্পানি থেকে ইস্তফা দেয় বার্ধক্যজনিত কারণে। এরপর ধীরে ধীরে কেটে যায় ৯ বছর। 

 

ততদিনে পালের হাওয়া বদলে ২০০৮ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দায় ফোর্ড কোম্পানির বেহাল দশা হয়ে পড়ে।

 

ফোর্ড হলো পৃথিবীর সেরা কার ম্যানুফ্যাকচারারের একটি, সেই তারাই সিদ্ধান্ত নিলো তাদের দুইটা ডিভিশন কে বিক্রি করে দিবে, তাও আবার সবচেয়ে দামী দুইটা ডিভিশন! কারণ এই দুই হাতি পালা ফোর্ডের মতো জায়ান্টের পক্ষেও আর সম্ভব হচ্ছিলো না!

 

বিক্রির খাতায় নাম উঠায় স্পটর্স কার ডিভিশন জাগুয়ার, আর লাক্সারি SUV ডিভিশন ল্যান্ড রোভার। উল্লেখ, আমার ড্রিম কার হচ্ছে Land Rover Discovery 4. 

 

ঠিক এ সময়ে তাদের ত্রাতা হয়ে এগিয়ে আসেন রতন টাটা। 

 

টাটা গ্রুপ ফোর্ড কোম্পানির দুইটি আইকনিক ব্র্যান্ড “জাগুয়ার ও ল্যান্ড রোভার” কিনে নেয় ২.৩ বিলিয়ন ডলারে!!!

 

সাধারনত এত বড় অংকের ডিলগুলো ক্যাশে হয় না! স্টকে পরিশোধ করা হয়, বা ক্যাশ দিলেও তা কয়েক বছর ধরে ইন্সটলমেন্টে দেয়া হয়। অনেক সময় স্টক + ক্যাশে মিলিয়ে ঝিলিয়ে দেয়া হয়।

 

কিন্তু রতন টাটা, ২.৩ বিলিয়ন ইউএস ডলার ফোর্ড কোম্পানিকে পরিশোধ করেছিলো পুরোপুরি ক্যাশ ডলারে! তাও আবার কোন ইন্সটলমেন্ট ছাড়াই!

 

কার ইন্ডাসট্রি তো বটেই, সমগ্র বিশ্বে তাক লেগে যায় এই ঘটনায়। একটা ইন্ডিয়ান কোম্পানি কিনে নিচ্ছে এত বছরের ডাক সাইটে দুইটা ব্রিটিশ কার ব্র্যান্ডকে!! এও কি সম্ভব?! 

 

বিশ্বের প্রায় সব কয়টা মিডিয়াতে এসেছিলো এই নিউজ! রতন টাটার অপমানের কথা মিডিয়াতে ফলাও করে প্রচার হয়নি ১৯৯৯ সালে, কিন্তু তার অপমানের প্রতিশোধের ঘটনা সারা বিশ্ব ফলাও করে প্রচার করেছিলো নিজ উদ্যোগে!

 

যে বিল ফোর্ড রতন টাটাকে অপমান করেছিলেন, তিনিই তখন বলেছিলেন, ”তুমি জাগুয়ার ল্যান্ড রোভার (JLR) কিনে নিয়ে আমাদের অনেক বড় উপকার করলে।” 

 

এই কথাটা বলার কারণ হলো, একমাত্র টাটা গ্রুপ ছাড়া সেই মন্দার সময়ে এত বেশী দাম দিয়ে JLR কিনতে আর কেউই রাজী হয়নি।

 

এবং ঐ সময়ে রতন টাটা যদি না কিনে নিতো তাহলে ফোর্ড কোম্পানি JLR কে দেউলিয়া ঘোষণা করতে বাধ্য হতো! মানে রতন JLR কে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করেছে!

 

৯ বছর আগে বলেছিলো, তোমার কোম্পানি কিনে আমরা দয়া করছি, আর এখন বল্ল, তুমি আমাদের কোম্পানি কিনে আমাদের দয়া করেছো! মাত্র ৯ বছরের মাথায় তাসের তুরুপ এভাবে একেবারে ৩৬০ ডিগ্রী উল্টে যাবে, এইটা হয়তো তারা কোনদিন দুঃস্বপ্নেও ভাবে নাই! এই সমুচিত শিক্ষাটা এই রেসিষ্টগুলোর দরকার ছিলো!

 

আর এভাবেই রতন টাটা প্রমান করে দিলেন- না তিনি মাফ করেন, না তিনি অপমানকে ভুলে যান! বিশ্বকে দেখিয়ে দিলেন, তিনি তার অপমানের প্রতিশোধ নিয়ে ছাড়েন, এবং সেটা একজন জাত ব্যবসায়ী মতোই!

 

পরবর্তীতে “জাগুয়ার ল্যান্ড রোভার (JLR)” টাটা গ্রুপের অধীনে আবারো একটি সফল ব্র্যান্ড হিসেবে গড়ে উঠে। অথচ এই কোম্পানির মালিককেই টিপ্পনি কাটা হয়েছিলো, তুমি গাড়ির কি বুঝ?

 

এই রকম অভূতপূর্ব ঘটনা পৃথিবীর অটোমেটিভ ইন্ডাসট্রিতে খুব সম্ভবত খুব বেশী ঘটেনি। ফেরারি বনাম ল্যাম্বরগিনিও অনেকটা এই রকম জেদাজেদি নজির! 

 

এই ঘটনাগুলো পরবর্তীতে ভারতীয় মিডিয়ার কাছে বলেন মি. প্রবীন কাদলে (currently the non- executive Chairman of Tata Auto-Comp Systems Limited), যিনি কিনা ১৯৯৯ এবং ২০০৮ - ফোর্ডের সাথে উভয় মিটিংয়েই উপস্থিত ছিলেন টাটা টিমের সদস্য হয়ে! তিনি বেশ কয়েকটা টিভি চ্যানেল ও পত্রিকার ইন্টারভিউ ও টক শোতে এই সব ঘটনা অনেক বার শেয়ার করেছেন ইতোমধ্যে!

 

যে ঘটনাটা হতে পারতো টাটা কোম্পানির ইতিহাসের সবচাইতে করুণ অধ্যায়, কিন্তু সেটাই হয়ে গেছে টাটার ইতিহাসের সবচাইতে সাফল্যের অধ্যায়ের একটা। শুধুমাত্র রতন টাটার দূরদর্শীতার কারণে!

 

আরো মজার ব্যাপার হলো, অপমানের প্রতিশোধ হিসেবে চড়া দামে JLR কিনে নিলেও শেষ পর্যন্ত কিন্তু দেখা গেছে, ব্যবসায়িকভাবেও টাটা কোম্পানির জন্য এই টেকওভারটা বেশ প্রফিটেবল ছিলো! এখন টাটা গ্রুপের ইন্টারন্যাশনাল রেভিনিউয়ের সবচাইতে বড় অংশ আসে JLR থেকে! এমনকি JLR কে বলা হয় টাটা মোটরসের গ্লোবাল অপারেশনের মেরুদন্ড!

 

এছাড়াও এই ঘটনার মাধ্যমে টাটা মটরস রাতারাতি বিদেশী গাড়ির বাজারে ঢুকে পড়ে, এবং বৈশ্বিক বাকী কার কোম্পানিগুলোও টাটাকে সমীহের সাথে দেখা শুরু করে। সুতরাং, এই ডিলটি টাটা কোম্পানির জন্য একটা বিশাল মাইল ফলক ছিলো বলা যায়!

 

ভাগ্যিস বিল ফোর্ড সেদিন রতন টাটাকে অপমানটুকু করেছিলো!

 

প্রচলিত আছে, সাফল্যই হলো সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিশোধ। সাফল্যের মাধ্যমে অপমানের বদলা নিয়ে ঠিক এই কথাকেই যেন প্রমাণ করেছিলেন রতন টাটা। 

 

এই ঘটনার আরো একটা শিক্ষা হলো, অহংকার যে পতনের মূল - তা পৃথিবীর সব জাগায় সব জাতির জন্যই প্রযোজ্য!

 

গত পরশুদিন রতন টাটা ৮৬ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন!

 

রেষ্ট ইন পিস ডিয়ার ইন্ডিয়ান বিজনেস টাইকুন!

 

সূত্রঃ দ্য হিন্দুস্থান টাইমস, দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া।

ছবিসূত্রঃ এশিয়ানেট নিউজেবল!

#TataMotors

#ratantata

#BusinessCaseStudies

Search
Categories
Read More
Home
Glyco Active: azúcar en sangre natural en México [Comprar ahora]
Controlar los niveles de glucosa es una parte esencial de mantenerse al día con las...
By Glyco Active 2025-02-08 14:59:15 0 3K
Shopping
22ct White Gold Bracelet: A Timeless Symbol of Elegance and Luxury
A 22ct white gold bracelet is the perfect blend of modern sophistication and...
By A1j Jewellers 2025-02-19 10:08:14 0 1K
Shopping
Dior contributing to a turnover of around billion
I recently bought a wrap that I can't wait to break out. College fashion programs have been on...
By Kennedy Marks 2025-03-22 13:46:14 0 1K
Health
SizeMD+ Plus Gummies UK: Check Here Its Benefits, Uses And Cost (Order Now)
SizeMD+ UK is a male upgrade supplement showcased to help different parts of male sexual...
By GlycoForte BloodPressure 2024-12-31 12:20:50 0 5K
Networking
GlycoBoost Blood Capsules Reviews: Check The Benefits And Side-Effects!
Glyco Boost is a distinctive nutritional supplement designed to assist in maintaining...
By Glyco Boost 2025-05-05 06:18:18 0 297