সিএনজি-চালিত গাড়িকে বিদায় জানানোর সময় এখন

0
6K
সিএনজি এখন আর ব্যয়সাশ্রয়ী নয়। এটি সংগ্রহে প্রচুর সময় অপচয় করতে হয় এবং সর্বোপরি দেশের জন্য আয়কারী এবং সবচেয়ে বেশি চাকরি দেওয়া শিল্পগুলোতে সরবরাহের জন্যও আমাদের কাছে পর্যাপ্ত গ্যাস নেই।
 

২০০১–০২ সালে বাংলাদেশ 'গ্যাসের ওপর ভাসছিল'। অন্তত বিশেষজ্ঞ এবং তেল কোম্পানিগুলোর একাংশ সেটাই দাবি করেছিল। তার কয়েক বছর আগে মার্কিন কোম্পানি ইউনোকল বিবিয়ানায় বিশাল গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে। কোম্পানিটি বলেছিল, এত বড় গ্যাসক্ষেত্রের বিকাশের জন্য বাংলাদেশের পর্যাপ্ত ভোক্তাই নেই। ইউনোকল সরকারের কাছে আবেদন করেছিল, এ গ্যাস যেন ভারতে রপ্তানির অনুমতি দেওয়া হয়।

সে সময় এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) পরিবহন খাতে সংকুচিত প্রাকৃতিক গ্যাসের (সিএনজি) ব্যবহার চালু করতে 'ক্লিন ফুয়েল প্রজেক্ট' নামক একটি সরকারি প্রকল্পে অর্থায়ন করে। আমাদের উদ্বৃত্ত পরিমাণ গ্যাস ছিল বটে, তবে পরিবহন খাত পরিচালনার জন্য বিপুল পরিমাণ তরল জ্বালানি আমদানি করতে হয়েছিল। ডিজেল ও পেট্রোলের পরিবর্তে সিএনজি ব্যবহার করলে আমাদের কেবল প্রচুর আমদানি ব্যয়ই সাশ্রয় হয় না, একইসঙ্গে তরল জ্বালানির চেয়ে সিএনজি অনেক বেশি পরিচ্ছন্ন বলে পরিবেশও কিছুটা রেহাই পায়।

সিএনজি যখন সবার পছন্দের ছিল

২০০২–০৩ সালে চালুর পর সিএনজি প্রকল্পটি বিপুলভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। একে তো এটি বিকল্প জ্বালানি হিসেবে সস্তা ছিল। এছাড়া সিএনজি রূপান্তর এবং পাম্পিং স্টেশনগুলোর জন্য নতুন ব্যবসার সুযোগ তৈরি হয় তখন। ওই সময় সারাদেশে শতশত সিএনজি স্টেশন গড়ে ওঠে। কয়েক বছরের মধ্যে লক্ষাধিক মোটর গাড়ি এবং তিন চাকার গাড়িতে সিএনজি ব্যবহার করে চালানোর জন্য উপযুক্ত করে পরিবর্তন আনা হয়।

পেট্রোবাংলার তথ্যমতে, ওই দশকের শেষ নাগাদ সিএনজি ৮০০ মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের পেট্রোলিয়াম আমদানির খরচ সাশ্রয় করছিল।

একই সময়, সিএনজি সরবরাহ নেটওয়ার্কের দ্রুত সম্প্রসারণ ২০১০ সালের মধ্যে গ্যাস সরবরাহের চাপের অস্থিতিশীলতায় উল্লেখযোগ্য প্রভাব রেখেছিল।

ততদিনে বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র স্থানীয় বাজারের জন্য বিপুল পরিমাণ গ্যাস উৎপাদন করছে। বাংলাদেশ কখনোই গ্যাসের সমুদ্রে ভাসেনি বরং গ্যাস সরবরাহের ঘাটতিতে ভুগছিল।

সিএনজি খাত দৈনিক দুই হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের এক দশমাংশ ব্যবহার করত। কিন্তু ইতোমধ্যেই ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট চাহিদার ঘাটতি ছিল। ফলে সরকার বাধ্য হয়ে সব ধরনের গ্রাহকের জন্য নতুন গ্যাস সংযোগ প্রদান বন্ধ করে দেয়। বিশেষ বিবেচনায় কিছু শিল্প সংযোগের অনুমতি পায়।

ক্ষয়িষ্ণু সরবরাহের মুখে কখনোই আমাদের চাহিদা পুরোপুরি পূরণ না করতে পারায় ওসব বিধিনিষেধ এখনও বহাল রয়েছে।

দেশের দ্রুত উন্নয়নের কারণে গ্যাসের চাহিদাও উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়তে থাকে। এতে বাধ্য হয়ে সরকার ২০১৮–১৯ সাল থেকে উচ্চমূল্যে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি শুরু করে। আমদানিকৃত এলএনজি স্থানীয় গ্যাসের সঙ্গে মিশিয়ে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হয় যাতে গ্যাসনির্ভর শিল্প ও অন্যান্য গ্রাহকেরা কাজ চালিয়ে নিতে পারে।

গত এক দশকে উল্লেখযোগ্য কোনো নতুন তেল ও গ্যাস আবিষ্কার হয়নি। ফলে গত চার বছর ধরে স্থানীয় উৎস থেকে গ্যাস সরবরাহ ক্রমাগত কমছে। বর্তমানে সরকার সর্বোচ্চ তিন হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করতে সক্ষম — যার মধ্যে ৬০০ থেকে ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট আসে আমদানি করা এলএনজি থেকে।

কিন্তু চাহিদার দিকটার কী পরিস্থিতি? ২০১০–১১ সালে দেশে গ্যাসের চাহিদা ছিল দুই হাজার ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট। গ্যাসের বার্ষিক চাহিদা বৃদ্ধি নিয়মিত প্রায় ১০ শতাংশের আশপাশে থাকা বিবেচনায় এটি পাঁচ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট অতিক্রম করার কথা।

ফলে আমাদের একটি বিশাল গ্যাসের ঘাটতি তৈরি হয়েছে যা দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনকে প্রভাবিত করছে। যদিও প্রায় এক দশক ধরে ভবিষ্যত বিদুৎচাহিদা মেটাতে আমাদের যথেষ্ট ক্যাপাসিটি রয়েছে।

সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখা শিল্পগুলো গ্যাস সংকটে বড় ভুক্তভোগী

যেসব শিল্প রপ্তানি ও স্থানীয় বাজারের জন্য বিদ্যুৎ, সার এবং কমোডিটি ইত্যাদি পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে প্রাকৃতিক গ্যাসের সর্বোচ্চ মূল্যবান ব্যবহার করছে, সেগুলোকেই গ্যাস সংকটের সঙ্গে মারাত্মকভাবে আপস করতে হচ্ছে। এসব শিল্প এখন গ্যাসের বিকল্প খোঁজার চেষ্টা করছে।

গত অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ৫৫ বিলিয়ন ডলার সম্ভব হয়েছে কেবল গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থার কারণে। পুরো অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির সিংহভাগও গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। তারপরও সংকটের কারণে এগুলো ভালোভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না।

সংকট সত্ত্বেও সিএনজির ব্যবহার এখনো বাড়ছে। সরকার কয়েক দফা সিএনজির দাম বাড়িয়েছে। যেখানে ২০১০-এর দশকে প্রতি ইউনিটের দাম ছিল প্রায় ১৬ টাকা, বর্তমানে সিএনজির ইউনিটপ্রতি দাম ৪৩ টাকা। সিএনজি নেওয়ার জন্য স্টেশনগুলোতে যানবাহনকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। এছাড়া গ্রাহকদের অভিযোগ, গ্যাস স্টেশন থেকে নেওয়া সিএনজি পুরোটা বিশুদ্ধ গ্যাস নয় এবং সিএনজি স্টেশনগুলো কাঙ্ক্ষিত গ্যাসের চাপ অনুযায়ী পাম্প করতে না পারায় প্রায়ই বাতাসের সঙ্গে এটিকে মিশ্রিত করা হয়। ফিলিং স্টেশনগুলোয় সিএনজি-চালিত গাড়ির দীর্ঘ সারি নগরীর বিভিন্ন সড়কে যানজট সৃষ্টি করে।

সিএনজি-চালিত গাড়ি আর সাশ্রয়ী নয়

সিএনজি এখন আর ব্যয়সাশ্রয়ী নয়। এটি সংগ্রহে প্রচুর সময় অপচয় করতে হয় এবং সর্বোপরি দেশের জন্য আয়কারী এবং সবচেয়ে বেশি চাকরি দেওয়া শিল্পগুলোতে সরবরাহের জন্যও আমাদের কাছে পর্যাপ্ত গ্যাস নেই।

বর্তমানে সারাদেশে ৫২৫টি সিএনজি স্টেশন রয়েছে। এগুলোতে দৈনিক ১০ লাখ গাড়িতে জ্বালানি সরবরাহ করা হচ্ছে। গ্যাস সংকটের কারণে সিএনজির ব্যবহার ২০১০ সালের ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট থেকে কমে ১২৫ মিলিয়ন ঘনফুটে নেমে এসেছে।

সবচেয়ে বড় পরিহাস হলো, সিএনজি সংস্কৃতি এমনকি পরিবেশবান্ধব কোনো 'পরিচ্ছন্ন জ্বালানি' ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে পারেনি। ঢাকার বাতাস বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ বাতাসের অন্যতম। সিএনজি ডিজেল বা পেট্রোলের চেয়ে পরিচ্ছন্ন বটে, তবে এটিও ক্ষতিকারক বিভিন্ন গ্যাস নির্গত করে।

গত দুই দশকে বাংলাদেশের আমূল পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে আমরা আমদানি করা জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমাতে নিঃসরণমুক্ত বৈদ্যুতিক যানবাহন, সৌর এবং বায়ু শক্তির দিকে নজর দিচ্ছি। পাশাপাশি কয়েক দশক আগের মতো পাইপযুক্ত গ্যাস সংযোগের পরিবর্তে নতুন নির্মিত বাড়িগুলোতে রান্নার কাজে এখন তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) দেওয়া হচ্ছে।

কিন্তু সিএনজি গাড়ির অস্তিত্ব নিয়ে আমরা এখনো উদাসীন।

সিএনজি-চালিত যানবাহন ধীরে ধীরে বন্ধ করার জন্য সরকারের নতুন একটি নীতি বিবেচনা করার উপযুক্ত সময় এখনই। পর্যাপ্ত গ্যাস না থাকার কঠিন বাস্তবতার সঙ্গে জাতিকে মানিয়ে নিতে হবে। সরকার তার নীতি পরিবর্তন না করলে সিএনজি নিয়ে বাতুলতা কেবল আমাদের হাইভ্যালু গ্যাস ব্যবহারকারীদের দুর্ভোগ বাড়াবে।

Like
Love
6
Search
Categories
Read More
Sports
Nuggets blow 20-place guide, battle against business as Timberwolves close their identify safety within just Activity 7
DENVERThe Denver Nuggets couldn't tranquil an epic minute-50 percent comeback by means of...
By Dever Ngets 2024-11-01 07:37:44 0 4K
Health
Back Pain Management: How to Keep Your Back Strong
Back Pain Management is essential for anyone looking to maintain a strong and healthy back,...
By George Zafiropoulos 2025-02-18 12:38:26 0 3K
Health
SizeMD+ Plus Gummies UK: For What Reason It Is The Best Male Enhancement?
Size MD+ Male Enhancement are dietary redesigns expected to help male sexual success and...
By Nexagen Male Enhancement 2025-02-15 19:37:57 0 1K
Shopping
photographer passed away at Dior Handbags the age of 42 from related
One of my many responsibilities was to design belts alongside my boss. is another strong option...
By Sunny Curtis 2024-08-31 10:34:06 0 9K
Other
Inoventive 3D: The Best Architectural Scale Model Making and 3D Printing Company
Architectural scale model making company:  In the heart of innovation and creativity,...
By Andrea Coleman 2025-02-24 07:35:16 0 2K