অভিমানী অহনা

0
4K
প্রায় বছর দুইয়েক পর অহনা নক দিলো ম্যাসেঞ্জারে। ভালো মন্দ জিজ্ঞেস না করে সোজা জিজ্ঞেস করলো, এই, লন্ডনের কই থাকো তুমি? এড্রেস কী?
রিপ্লাই দিলাম, কেন গিফট পাঠাবা নাকি?
বললো, পাঠাতেও পারি।
এড্রেস দিয়ে টুকটাক কথা হলো। কেমন আছো, স্বামী, বাচ্চারা কেমন আছে এইসব আর কী।
তার সাথে কথা বলার ঘন্টা দুয়েক পরে দরজায় নক পড়লে দরজা খুলে দেখি অহনা!
আমি স্বপ্ন দেখছি কিনা বুঝতেছি না। পেছনে তার বর আর বাচ্চা দুইটা।
আমি কী বলবো বুঝতেছি না। ঘোরে চলে গিয়েছি মনেহচ্ছে।
অহনা হাসি দিয়ে বললো, কি, ভয় পাইছো?
তার বরের সাথে হাত মিলিয়ে বাসার ভেতরে নিয়ে আসলাম তাদের।
আমি এখনো বুঝছি না হচ্ছেটা কী! অহনা তার বরের সাথে থাকে আমেরিকা। বিয়ের প্রায় তিন বছর পর আমেরিকা চলে যায় বরের কাছে। বছর সাতেক আগে আমাদের প্রেমের ইতি ঘটে! তখন আমরা দুইজনেই দেশে ছিলাম। আমার প্রাক্তন তার বর বাচ্চা নিয়ে আমার ঘরে, আমার ঘোরে না গিয়ে উপায় আছে?
অহনার বর বেচারা একটু বিব্রত মনেহচ্ছে। উনি আমার কথা জানেন, মানে অহনার একটা প্রেম ছিলো জানতেন। কিন্তু আমাকে এই প্রথম দেখলেন মনেহয়।
অহনা ড্রইং রুমে বসতে বসতে বললো, আমেরিকা থেকে বেড়াতে এসেছিলাম লন্ডনে। ভাবলাম তোমার সাথে দেখা করেই যাই। আজকে রাতে তোমার এখানে খাবো। দেখি কেমন রান্না শিখেছো তুমি! একাই থাকো?
বললাম, না, ফ্রেন্ড আর তার ওয়াইফ থাকে আমার সাথে। ওরা দেশে গিয়েছে ছুটিতে। এখন একাই থাকা হয়। তুমি আমাকে না বলে আসলে, যদি কাজে থাকতাম? এসে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো!
অহনা বললো, আরে সারপ্রাইজ নষ্ট হয়ে যেতো না তাহলে?
রাতের খাবার আমার রান্না করার কথা থাকলেও অহনা নিজেই রান্না ঘর দখল করে নিলো! আমাকে বললো, তুমি আমার বরকে সময় দাও। একদিন নাহয় আমার হাতে রান্না খেলে।
অহনার ছেলে মেয়ে দুইটাকে খেলানা দিয়ে বসিয়ে গার্ডেনে বসলাম আমি আর অহনার বর।
ভদ্রলোক এখনো মনেহয় খুব বিব্রত। আমি ওনাকে ইজি করতে বললাম, ভাই! আপনি প্লিজ লজ্জা পাবেন না, বিব্রতবোধ করবেন না। পৃথিবীটা অদ্ভুত একটা জায়গা। মাঝেমাঝে আমাদের নানা অদ্ভুত সময়ের মধ্য দিয়ে যাওয়া লাগে। আমি ভয়ে আছি আপনার বউ না খাবারে বিষ দিয়ে আমাকে মেরে ফেলে, সাত বছর আগে তাকে একা ফেলে চলে আসার কারণে!
ভদ্রলোক আমার কথা শুনে একটু ইজি হলেন। হেসে দিলেন। লোকটার হাসিটা খুব সুন্দর। বললেন, ভাই যদি বিষ দিতো, তাহলে আমাকেই দিতো! তবে আমিতো জানি অহনা আপনাকে ছেড়েছে, আপনি না। মানে ওর বাবা আপনাদের সম্পর্কটা মানেন নাই। অহনাও বাবার বিপক্ষে যেতে পারে নাই।
ভদ্রলোক চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললেন, ভাই বিয়ের আগে অহনা আর আপনার সব কিছু অহনা আমাকে বলেছিলো। বলেছিলো, বাবার ইচ্ছাতেই বিয়েটা করছে সে! ভাই জানেন এখনও প্রায় নিজেকে ভিলেন ভিলেন লাগে!
আমি বললাম, ছিঃ ছিঃ ভাই! একি কথা! রাখেন না আগের কথা! আপনাদের কী সুন্দর সংসার! দুইটা সুন্দর সুন্দর বাচ্চা! এগুলো মনে করবেন না। ভাগ্য হয়তো আমাদের সাথে ছিলো না।
ভদ্রলোক বললেন, না, না ভাই, আমি সুখি মানুষ!অহনার মতন বউ যার পাশে থাকে সে সুখি না হয়ে পারে? তবে জানেন আমার নায়ক হওয়ার সুযোগ ছিলো! অহনা যখন আমার সাথে দেখা করে বলেছিলো, ওর প্রেম আছে। প্রচণ্ড ভালোবাসে সে ছেলেটাকে। আমি বুঝতেছিলাম সে চাচ্ছে বিয়েটা ভেঙ্গে দেই আমি। আমি না পারি নাই ভাই! অহনার মায়ায় পড়ি! আমার মনেহয় হয়েছিলো এই মেয়ের সাথে সংসার করতে না পারলে মরে যাবো! আমি নায়ক হলে আজকে হয়তো আপনাদের সংসারটা হতো! অহনার বিয়ের পর আমাকে বলেছিলো, আমি একজনকে ভালোবাসতাম, হয়তো এখনো বাসি তবে সেটা মানে এই না আমি সংসার করবো না, তোমার প্রতি ভালোবাসা আসবে না বা কোনোভাবে তোমাকে ঠকাবো। এটা আমি কখনো করবো না। একজন স্ত্রী হিসেবে আমার সব দায়িত্ব আমি পালন করবো। করেছেও মেয়েটা। করে যাচ্ছে। আমি ভীষণ সুখি একজন মানুষ ভাই! আমি জীবনে কোনো একটা বড়ো পুণ্য করেছিলাম বলেই মনেহয় এই মেয়েটাকে পেয়েছি!
এইটুকু বলতে বলতে ভদ্রলোক কেঁদে দিলেন! এবার আমি বিব্রত হলাম! ভদ্রলোক বললেন, ভাই আপনাকে একটা কথা জানাবো। অহনার বছর খানেক আগে ক্যান্সার ধরা পড়ে। চিকিৎসা চলছে কিন্তু খুব একটা লাভ হবে না। আপনি হয়তো জানেন আমি নিজেও ডাক্তার।
আমি ভদ্রলোকের কথা শুনে কেমন জানি শূন্য হয়ে গিয়েছি! উনি কী বলছেন এই সব!
ভদ্রলোক আবার বলা শুরু করলেন, ও খুব দ্রুত অসুস্থ হচ্ছে। লন্ডনে ঘুরতে আসার পাগলামি করে। আমাকে বললো, আমি কিছুদিন পরেই মারা যাবো! আমাকে একটু লন্ডন ব্রিজ দেখিয়ে আনো! আমি পাগলামি প্রশ্রয় দিলাম। কিন্তু এখানে আসার পরে জানলাম, এখানে আসা শুধু আপনার সাথে একবার দেখা করার জন্যে!
লন্ডন ব্রিজ দেখে হোটেলে ফেরার পথে গাড়িতে আমাকে হাত ধরে বললো, জানো যেদিন রানার সাথে শেষ দেখা করি, পাগলের মতন চিৎকার করে কাঁদছিলো রানা! ধানমন্ডি লেকে একজন প্রেমিক তার প্রেমিকাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদছিলো আর আকুতি মিনতি করে বলছিলো, আমাকে ছেড়ে যেও না প্লিজ! আমি তোমার বাবার পায়ে ধরে তোমাকে চাইবো! তোমার সুখের জন্যে আমি সব করবো! প্লিজ আমাকে ছেড়ে যেও না! নিষ্ঠুর আমি বলেছিলাম, আমার সুখের জন্যে আমাকে ছেড়ে দাও তাহলে! আমাকে এই শেষ সময়টায় একটাবার রানার সাথে দেখা করতে দিবা?
অহনার বর একটু থেমে বললেন, জানেন গত সাত বছর অহনা তার বাবার সাথে একটা শব্দও বলে নাই! একটা ওয়ার্ডও না! বলে, আমার বাবা আমার সুখ চেয়েছেন, আমি সুখি আছি। জন্মদাতা বাবা আমাকে জন্মানোর অধিকার খাটিয়েছেন, মানুষ হিসেবে আমারও অধিকার আছে কার সাথে কথা বলবো না বলবো তার!
এইসব কাহানীতে ভাই মাঝেমাঝে নিজেকে ভিলেন মনেহয়! তবুও আমি স্রষ্টার কাছে কৃতজ্ঞ অহনার মতন বউ পেয়েছি! যে একজন স্ত্রী যেমন তেমনি একজন প্রেমিক হারানো প্রেমিকাও!
দুনিয়ায় আমার যত ক্ষমতা আছে আমি চেষ্টা করে যাবো আমার অহনার সুস্থতার জন্যে! তবুও আমি জানি আমাকে হার মানতে হবে! আমি আর আমার অহনাকে পাশে পাবো না কখনোই! তবুও কত মিরাকল হয় না ভাই? একটা মিরাকল হোক! আমিতো এইও পণ করেছি অহনা সুস্থ হয়ে গেলে আমি তাকে বলবো, তুমি আমাকে ছেড়ে যেতে পারো অহনা। তুমি যেখানে সুখে থাকবা সেখানেই যাও! তবুও তুমি বেঁচে থাকো! নিশ্বাস নাও!
রান্নাঘর থেকে অহনার ডাক আসলে আমাদের কথায় বাধা পড়ে। ধানমন্ডি লেকে আমি আর অহনা প্রায় দেখা করতাম। সে প্রায় এটা সেটা রান্না করে নিয়ে আসতো আমার জন্যে। তারমধ্যে তার হাতের গাজরের হালুয়া ছিলো আমার সবচেয়ে প্রিয়! নীল একটা বক্সে খাবার টেবিলে দেখলাম হালুয়া রাখা। অহনা বললো, খেয়ে দেখো। নষ্ট হওয়ার কথা না। আমেরিকা থেকে আনা। ফ্রোজেন করে এনেছি। স্বাদ আছে কিনা কে জানে।
বললাম, খাবো। রেখে দাও।
রাতে অহনারা বিদায় নিলো আমার কাছে। অহনার বর ভদ্রলোক বাচ্চা দুইটাকে নিয়ে আমাদের একা ছাড়লেন কিছুক্ষণের জন্যে।
অহনা বললো, আমার বর তোমাকে আমার অসুখের কথা বলেছে নিশ্চয়। ভণিতা করবো না। আমার তোমাকে একবার সামনাসামনি দেখার ইচ্ছা ছিলো। আর এই চিঠিগুলো রাখো। তোমার দেওয়া একশো আটাশিটা চিঠি। এই চিঠি গুলো পুড়িয়ে ফেলার অনেকবার চেষ্টা করেছি পারি নাই। আমার ভালোমন্দ কিছু হয়ে গেলে চিঠিগুলো অযত্নে থাকবে তাই তোমাকে দিয়ে গেলাম। আর যদি বেঁচে যাই ফেরত পাঠিয়ে দিও! আর শুনো, আমি সুখি একজন নারী। আমার সুখের সংসার। তোমার জন্যে প্রেম নাই। ভেবো না আমি এখনো তোমার প্রেমে অন্ধ! দুই বাচ্চার মা হয়েছি! এখন আর এইসব বাংলার ছবির সময় আছে বলো? তবুও তোমার প্রতি জন্মদিনে আমি সুন্দর মতন সাজি। একটা করে গিফট কিনি। যেদিন তোমার আমার প্রথম দেখা হয়েছিলো চব্বিশ জুলাই, আমি সেদিন একা একা ঘুরতে বের হই! আমার বর সব জানে। আমি বলি নাই তবুও বুঝে ও। জানো রানা, আমার দেখা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ একজন মানুষ ও! আচ্ছা এইসব কেন বলছি আমি জানি না রানা। আমার হয়তো সময় কম তাই যা ইচ্ছা বলে যাচ্ছি। তুমি যে চোখের জল আমার জন্যে ফেলেছিলে তার প্রতিদানে আমি হাজার বছর কাঁদলেও তোমার কাছে ক্ষমা পাবো না জানি। তাই ক্ষমা চাইবো না। তবুও বলি আমার উপর অভিমান রেখো না রানা। আর সত্য সত্য মিরাকল হলে আমার চিঠিগুলো আমার কাছে ফেরত পাঠাবে! মনে থাকে যেন! আর তোমার সাজানো জীবনে একদিনের জন্যে এসে কোনো কষ্ট দিয়ে থাকলে আমার অধিকার থেকেই দিয়েছি! কিন্তু আমার কি তোমার প্রতি কোনো অধিকার আছে এখনো? আছে হয়তো!
অহনারা চলে গেলে আমি তার হালুয়ার বাটিটা নিয়ে বসলাম। প্রিয় এই খাবার খাওয়া বাদ দিয়েছি সাত বছর হয়! আমার ভীষণ কাঁদতে ইচ্ছা করছে অহনার জন্যে! কেন জানি কাঁদতেও পারছি না! আমার ভীষণ ইচ্ছা করছে চিৎকার করে আবার বলতে, আমাকে ছেড়ে যেও না! আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে!
অহনার চিঠিগুলো আমার কাছে যত্নে আছে। প্রায় বের করে পড়ি আর পুরানো কথা মনে করি। চিঠি গুলো তাকে তার ফেরত দেওয়ার সুযোগ হয় নাই।
নাহ! কোনো মিরাকল অহনার সাথে হয় নাই! পৃথিবীর এক প্রান্তে একজন মমতাময়ী অহনার জন্যে প্রার্থনায় বসেছিলো একজন বউ পাগল স্বামী আরেক প্রান্তে একজন প্রেমিক! তবুও স্রষ্টার মন গলে নাই! তবুও অভিমানী অহনা আর আমাদের সাথে থেকে যায়নি।
____(সমাপ্ত)____
Love
1
Search
Categories
Read More
Health
The Benefits of Cialis Daily: Improving Sexual Health
Cialis (tadalafil) has become a popular and effective treatment for erectile dysfunction (ED),...
By Limson Bros 2024-10-18 09:49:32 0 3K
Health
How Treme Skin Tag Remover Successfully Targets Skin Labels on Your Body?
Treme Skin Tag Remover is an effective arrangement intended to assist people with eliminating...
By Nexagen Male Enhancement 2025-01-02 17:24:49 0 1K
Other
Find the personal injury lawyer Harrisburg pa
Navigating the complexities of personal injury law in Harrisburg, PA can be a daunting task for...
By Digital List 2024-12-31 11:42:19 0 4K
Shopping
What Price Is New Golden Goose Sale
What Price Is New Golden Goose Sale
By Sunny Curtis 2024-09-03 11:40:03 0 6K
Shopping
Essentials Hoodies
Embrace Comfort and Style with Essentials Hoodies. Discover the Unique Design  In a world...
By Authur Authur 2024-11-05 15:54:08 0 3K