লোক দেখানো পেশাজীবীদের গল্প

বেশ কয়েক বছর আগের কথা, তখন আমার ফ্রিল্যান্সিং কাজের খুব রমরমা অবস্থা ছিল, নিজকে বিরাট কিছু মনে হত। একদিন রাতে বাজার করে ভ্যানে করে আসার সময়, এলাকার ভ্যানওয়ালা ভাইয়ের সাথে আলাপ হচ্ছিল। জমি নিয়ে কথা শুরু হলে সে আমাদের বাড়ীর পাশের রাস্তার ধারে, কয়েক কাঠা জমি দেখিয়ে বলেছিল যে, কিছুদিন আগে এই জমি ২৬ লাখ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম কে কিনেছে? সে এলাকার এক ভ্যানওয়ালার নাম বলল, শুনে আমি লজ্জা পেলাম, কারন আমি ধারনা করেছিলাম যে, হয়ত কোন ঘুষখোর চাকুরীজীবী বা ব্যাবসায়ি জমিটা কিনেছে। কিন্তু একজন সামান্য ভ্যানওয়ালা এত দাম দিয়ে জমি কিনছে সেটা মানতে কিছুটা কষ্ট হল। বুঝতে পারলাম অনলাইনে সামান্য কিছু টাকা ইনকাম করে, নিজেকে বিরাট কিছু ভাবা আমি, এই সমাজের কাছে আসলে কতটা নগণ্য। আরো বুঝলাম মানুষের কি পরিমাণ সম্পদ আর টাকা থাকতে পারে, সেটা নিয়ে আমাদের কোন ধারনাই নাই।
আমাদের বাজারে অনেক পুরাতন ঝালমুড়ির দোকানে নিয়মিত মুড়ি মাখানো খাই। সেদিন দোকানদার মুরব্বী আর তার ছেলের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ হচ্ছিল। কথা প্রসঙ্গে জানলা্ম কিছুদিন আগে তারা ৩৬ লাখ টাকা দিয়ে একটা ভাল ধানি জমি কিনেছে। দলিল বাবদ আরো কয়েক লাখ যাবে। আমি অবাক হইনি। অনেক বছর আগে, সোনালী ব্যাংকে চাকরী করা এক ছোট ভাই খুব করে ধরেছিল, সে ওয়েব ডিজাইন শিখে ফ্রিল্যান্সিং করবে। তাকে কিছু টিউটরিয়াল আর গাইডলাইন দিয়ে হেল্প করেছিলাম। সে অনেক দিন লেগেছিল, কিন্তু চকারি আর ফ্রিল্যান্সিং দুইটাতে ব্যালান্স করতে পারেনি। অফিসে বসে সে মার্কেটপ্লেস ব্রাউজিং, বায়ারের কাজ করা এসব করত। সবাই জেনে যাওয়াতে তার চাকরিতে অনেক ঝামেলা হয়েছিল, পানিশমেন্ট হিসাবে পুরা বাংলাদেশে তাকে ট্যুরের উপর থাকতে হত। এই কারনে তার প্রতি একটা করুনা ছিল, আহা বেচারা
অনেক দিন পর তার সাথে একদিন দেখা হয়েছিল। কেমন চলছে জিজ্ঞেস করলাম, সে জানিয়েছিল ফ্রিল্যান্সিং এর ভুত মাথা থেকে নেমে গিয়েছে, চাকরী নিয়ে সে ভাল আছে, আরো জানিয়েছিল ৫ তালা ফাউন্ডেশন দিয়ে দুই ইউনিটের দোতলা বাসা কমপ্লিট করেছে। বাড়িতে দোকান জমি রেখেছে, আমি কিছুটা অবাক হয়েছিলাম, কারন জানতাম তার দিনকাল ভাল যাচ্ছে না। কিন্তু এর মধ্যেই সে যে এতকিছু করে ফেলেছে, জেনে অনেক অবাক হয়েছিলাম।

যখন ফারমসিউটীক্যাল কোম্পানিতে জব করতাম, আমার কাজই ছিল ডাক্তার আর ফার্মেসি নিয়ে। মানুষ কিভাবে কত টাকা কামায় স্বচক্ষে দেখেছি। এমন এমন ডাক্তারদের সাথে পরিচয় ছিল, দিনে .৪/৫ লক্ষ টাকা করে কামাত। বড় ট্রিলি ব্যাগ ভরে টাকা নিয়ে, চেম্বার থেকে বের হতে দেখেছি। এসব সেই ১৪ বছর আগের কথা, এখনত তাদের ইনকাম আরো বেশি হবে। আমার আগের চাকরীর কলিগদের সাথে এখনো মাঝে মাঝে আলাপ হয়, বেশির ভাগই এখন বিভিন্ন কোম্পানির বড় বড় পদে আছে। অনেকেরই ঢাকায় এক বা একাধিক ফ্লাট বা প্লট আছে। অধিকাংশই কোম্পানির দেয়া দামী মডেলের গাড়ি ইউজ করে। এভাবে বলতে গেলে আসলে বলে শেষ করা যাবে না। তবে এই সব সফল লোকদের মধ্যে একটা কমন মিল আছে, সেটা হচ্ছে তারা তাদের সাফল্য অন্যদের বলে বেড়ায় না। একটা প্লট বা বাড়ি করে বা একটা গাড়ী কিনে ছবি তুলে তারা ফেসবুকে দেয় না। তারা তাদের পেশা নিয়েই ব্যাস্ত এসব লোক দেখানোর সময় তাদের নেই।
অনেকে বলতে পারেন, তারা হয়ত দুই নাম্বারি করে এই জন্য অন্যদের সাথে শেয়ার করে না, এটা আপনাদের ভুল ধারনা। উপরের যাদের কথা বললাম, তারা সবাই কষ্ট করে বৈধ ইনকাম করে খায়। চাইলে যে কোন পেশাতেই হিসাব করে চললে, কোন ধরনের দুই নাম্বারি ছাড়াই, বৈধ ভাবেই অনেক কিছু করা যায়। উদাহরণ হিসাবে বলতে পারি, একজন ব্যাংকার কিছু দিন চাকরী করার পরেই ১ কোটি টাকা পর্যন্ত ব্যাংক লোণ পেতে পারে। সেটা দিয়ে জমি কিনে রাখলে, কয়েক বছর পর ডাবল দামে বিক্রি করে ফেলতে পারে। এভাবে তারা অনেক কিছুই করে। সরকার, সরকারী ভাবে সরকারী কর্মচারিদের জন্য অনেক কিছু করে। যেমন একজন আর্মি বা পুলিশ অফিসার চাকরীর কিছু দিন পরেই, সরকারী ভাবে প্লট পেতে পারে, বিদেশে মিশনে যাবার সুযোগ পায়, সেখান থেকে মোটা অংকের ইনকাম হয়। মনে আছে পবিত্র হজ্জ পালনের সময় জেনেছিলাম, হজ্জ মিশনে যাওয়া একজন নার্স বা ব্রাদার ৭/৮ লক্ষ টাকা সরকারী ভাতা পেতে পারে, একজন ডাক্তার ১৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত সরকারী ভাতা পেতে পারে। এভাবে আরো অনেক কিছু বলা যায়। আর যারা হারাম ইনকাম করে, তারাত কোন কিছু শেয়ারই করে না। মুল কথা হচ্ছে কোন পেশাজীবীই তারা সাফল্য জনসম্মুখে প্রকাশ্যে বলে না। কারন তারা জানে এসব প্রকাশ্যে বলা মানে নিজের বিপদ ডেকে নিয়ে আসা। তাই তারা নিজেদের কাজ নিয়ে ব্যাস্ত থাকে।
কিন্তু আমি আজকে এমন এক পেশাজীবী সম্প্রদায়ের কথা বলব, যারা তাদের যে কোন সাফল্য, সেটা হোক সামান্য, সেটা লোকজনদের সামনে প্রকাশ না করলে পেটের ভাত হজম হয় না। আপনারা এতক্ষণে বুঝে ফেলেছেন, আমি কাদের কথা বলছি। ফ্রিল্যান্সারদের মত এমন জোকার বা ক্লাউন পেশাজীবী আমি আর দেখিনি। একটা মোটরসাইকেল কিনেছে, সেটা ঢাকঢোল পিটিয়ে সবাইকে জানাতে হবে, ভিডিও করে ফেসবুক ইউটীউবে ছাড়তে হবে। ভাল ইনকাম হয়েছে, সেটা স্ক্রিনশট না দেয়া বা ATM থেকে টাকা তোলার ছবি না দেয়া পর্যন্ত শান্তি নেই। একটা গাড়ী কিনেছে সেটার ছবি বা ভিডিও সকাল বিকাল ফেসবুকে দিতে হবে। গাড়ির ছবি দিয়ে বলতে হবে সব সুখ গাড়ীর মধ্যে, বাড়ি করলেত কথা নেই, কতদিন পর্যন্ত সেটার গল্প বলতে থাকবে সেটা আল্লাহ্ই ভাল জানেনে। এমনকি ৫০০ টাকা দিয়ে পিসিতে RGB স্ট্রিপ লাইটীং লাগানোর পর, সেটার ছবি ফেসবুকে দিয়ে Dream Comes True না বললে চলে না। এভাবে বলতে গেলে বলে শেষ করা যাবে না। দেশি মুরগী একটা ছোট ডিম পারলেও চিৎকার করে, আশেপাশের পুরা এলাকা উদ্ধার করে। ঠিক তেমনি আমাদের যে কোন ছোট সাফল্যও সবাইকে না জানালে আমাদের চলে না। আমাদের এই জোকারের মত কার্যকলাপের পূর্ণ সুযোগ নেয় মিডিয়া। এমন কোন দিন নেই ফ্রিল্যান্সারদের সাফল্য নিয়ে মিডিয়াতে কোন নিউজ পাবেন না, শিরনামও সেই লেভেলের, আগে দিন মজুরি করত, গার্মেন্টসে কাজ করত, বা মানুষের জমিতে শ্রমিকের কাজ করত, চা বিক্রি করত এমন বিচিত্র পেশাজীবীরা এখন সবাই ফ্রিল্যান্সিং নামের চেরাগ হাতে পেয়ে, ঘরে বসে মাসে ৫-৭ লক্ষ টাকা ইনকাম করছে।
আমাদের এই লোক দেখানো নেগেটিভ কাজ, আর মিডিয়াতে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে নিউজ করার কুফল এখন আমরা হাতে নাতে পেতে যাচ্ছি। সরকারের উপরের মহল থেকে শুরু করে দেশের সব মহলে চাউর হয়ে গেছে যে, ফ্রিল্যান্সার মানেই লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি টাকা। এত টাকা এরা কামাই করে। কাজেই এদের কাছ থেকে ট্যাক্স আদায় না করলে কিভাবে চলে। আগে আইটি ইন্ডাস্ট্রির ২৭ টা ক্যাটাগরি ট্যাক্স ফ্রি ছিল সেটা এখন ১৯টিতে নামিয়ে আনা হয়েছে। ২০২৭ পর্যন্ত ফ্রিল্যান্সিং সেক্টর সহ এসব আইটি সেক্টর করমুক্ত থাকবে বাজেটে ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু লিখে রাখেন আজ হোক কাল হোক, সবার উপর ট্যাক্স বসবেই। ভাবেছেন ডলার বেঁচে বা হুন্ডীতে টাকা আনবেন। সেখানেও বিপদ আছে, কারন সরকার NBRকে যদি সব ব্যাংকের একাউণ্ট এক্সেস করা সুযোগ দেয়, তবে মনে রাখবেন, কোন মতেই জরিমানা থেকে রেহাই পাবেন না। অথচ বিশ্বের প্রায় সব দেশে ফরেন রেমিটেন্স ট্যাক্স ফ্রি। কারন ফরেন রেমিটেন্স একটা দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন বলা যায়। এই জন্য প্রায় ৫৫টা দেশ ফ্রিল্যান্সারদের জন্য পুরা ট্যাক্স ফ্রি ডিজিটাল নোম্যাড ভিসা ইস্যু করে, শুধুমাত্র আপনার অর্জিত ডলার যেন তাদের দেশের অর্থনীতিতে যুক্ত হয়। অথচ আমাদের দেশে এটার সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র।
পরিশেষে বলব, আপনারা যারা জোকারের মত আপনাদের সাফল্য, সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রকাশ করেন, আপনাদের লজ্জিত হওয়া উচিৎ। আপনাদের এই বোকার মত কাজ ফ্রিল্যান্সিং সেক্টরের মত একটা উদীয়মান সেক্টরেকে হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে মাসে গড়ে ১ হাজার ডলার ইনকাম করে, এমন ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যা ১% এরও কম। ইনকামের দিক দিয়ে বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সিং আইটী সেক্টর বিশ্বের সব দেশের মধ্যে ৩০ তম দেশ হওয়া আমাদের দৈন্য দশাই প্রকাশ করে। এর পরেও বলব ফ্রিল্যান্সিং বা আইটি সেক্টরে আমাদের ভাল করা যথেষ্ট সুযোগ আছে, শুধু দরকার সঠিক পরিকল্পনা এবং সরকারের সহযোগিতা। আশা করি আমাদের সবার শুভ বুদ্ধির উদ্য় হবে।

Поиск
Категории
- Art
- Causes
- Crafts
- Dance
- Drinks
- Film
- Fitness
- Food
- Игры
- Gardening
- Health
- Главная
- Literature
- Music
- Networking
- Другое
- Party
- Religion
- Shopping
- Sports
- Theater
- Wellness
Больше
How Enki Elixir Will Develop Memory Power And Mind Wellbeing?
The Enki Elixir Drops is a nourishing enhancement intended to normally further develop cerebrum...
How to Find the Best Deals on Essentials Sweatpants
Essentials sweatpants are a popular choice for those who value comfort and style, making them a...
Calcium Citrate Price Trend: A Comprehensive Analysis of Market Dynamics, Pricing Charts, and Index Insights
The Calcium Citrate Price Trend has become an essential indicator for multiple industries,...
পাঁচ বছর প্রেমের পর শেহতাজকে পেয়েছি: প্রীতম
মডেল ও অভিনেত্রী শেহতাজকে বিয়ে করেছেন সংগীতশিল্পী প্রীতম। শুক্রবার (২৮ অক্টোবর) মৌলভীবাজারের...
How Nexagen Testosterone Booster Is A Superior Enhancement For Men's Wellbeing?
In the mission for worked on sexual flourishing and execution, different men are going to normal...