একটা ছোট গল্প...

0
3K
এক শুক্রবার সকালে স্ত্রী বললো,"চলো, আজ ডিনারটা বাইরে করি।"
বাইরে অর্থাৎ রেস্টুরেন্টে খাওয়ার কথা শুনলে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।
ধমকে বললাম,"বয়স যতো বাড়ছে ততো কি বাচ্চা হয়ে যাচ্ছো? ছেলেমেয়ে নিয়ে বাইরে খেতে গেলে কী পরিমাণ খরচ হয় তোমার ধারণা আছে? টাকা কামাতে কষ্ট হয়। বাসায় থেকে সেটা তো আর টের পাও না। আছো শুধু শখ আহ্লাদ নিয়ে।"
কথা শুনে স্ত্রীর মুখ অন্ধকার হয়ে গেলো।
ঐ দিন বিকেলে বন্ধুদের আড্ডায় এক বন্ধু বললো,"আমার স্ত্রীর একটা বাজে অভ্যাস আছে।"
অন্য বন্ধুরা জানতে চাইলো,"কী বাজে অভ্যাস?"
বন্ধুটি উত্তরে বললো,"ওর বাইরে খাওয়ার ঝোঁক বেশি। বন্ধের দিনগুলোতে কিছুদিন পর পরই বলবে, চলো আজ বাইরে লাঞ্চ করি কিংবা ডিনার করি। বুঝতে চায় না বাইরে খেলে প্রচুর টাকা নষ্ট হয়।"
সঙ্গে সঙ্গে আমি বললাম,"এই বাজে অভ্যাস তো আমার স্ত্রীরও আছে।"
আরেকজন বললো,"আমার স্ত্রীরও তো এই বাজে অভ্যাস রয়েছে।"
এভাবে একে একে সব বন্ধুরা বলতে লাগলো তাদের স্ত্রীদেরও এই বাজে অভ্যাস রয়েছে।
আমি ভাবলাম, আমার স্ত্রীরই বুঝি একা এই বাজে অভ্যাস রয়েছে, কিন্তু এখন দেখলাম এটা সব স্ত্রীদের মধ্যে রয়েছে। ব্যাপারটা কী?
আমরা বন্ধুরা এবার বলতে লাগলাম, কেনো স্ত্রীদের বাইরে খাওয়ার ঝোঁক বেশি থাকে?
এক বন্ধু বললো,"স্ত্রীরা হলো কাজ চোর। অলস প্রকৃতির। এজন্য রান্নাবান্না না করে বাইরে খেতে চায়।"
অন্য এক বন্ধু বললো,"স্ত্রীরা হলো বিলাসী মানসিকতার। এজন্য বাইরে খেতে চায়।"
আরেক বন্ধু বললো,"স্ত্রীরা অবিবেচক। এজন্য
স্বামীদের সামর্থ্যের কথা চিন্তা না করে বাইরে খেতে চায়।"
আমাদের বন্ধুদের মধ্যে একজন আছে রেস্টুরেন্টের শেফ।
সে বললো,"আমি বুঝি না রান্না করা কী এমন কঠিন কাজ? ১৫ বছর ধরে আমি রান্নার কাজ করছি। কই কখনো তো আমার কাছে এটাকে কঠিন মনে হয় নি।"
আরেক বন্ধু বললো,"মেয়েরা ভালোবেসে রান্না করে না। অনাগ্রহ নিয়ে করে। অনাগ্রহ নিয়ে করে বলেই রান্নাকে ওদের কাছে কঠিন মনে হয়। আর এজন্য বাইরে খাওয়ার দিকে ওদের এতো আগ্রহ।"
অন্য এক বন্ধু বললো,"কাজকে ভালো না বাসলেও তো কাজ করতে হয়। আমাদের পুরুষদের মধ্যে বেশির ভাগই অফিসের কাজ ভালোবাসে না। তবু কি আমরা দিনের পর দিন কাজ করে যাচ্ছি না? আসল কথা হলো, মেয়েদের ধৈর্য কম। এজন্য রান্নাবান্না না করে বাইরে খেতে চায়।"
স্ত্রীরা কেনো বাইরে খেতে যেতে চায় ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেলো।
সেদিন স্ত্রীকে শিক্ষা দেয়ার জন্য রাতের রান্না করতে আমি রান্নাঘরে ঢুকলাম।
আমাকে রান্না করতে দেখে স্ত্রী রান্নাঘরের দরোজায় এসে দাঁড়ালো। সে কিছু বলার আগেই বন্ধুদের কাছ থেকে শোনা কথাগুলো সব শুনিয়ে দিলাম।
শেষে বললাম,"অলসতা, বিলাসিতা, অবিবেচনা এসব বাদ দাও। দেখবে রেস্টুরেন্টে গিয়ে টাকা নষ্ট করার কথা আর মাথায় আসবে না। তোমরা মেয়েরা রান্নাকে ভালোবাসো না বলে এটাকে কঠিন মনে হয়। অথচ রান্নার মতো সহজ আর কিছু আছে? এই যে আমি এখন রাঁধছি, আমার কাছে এটাকে মোটেই কঠিন মনে হচ্ছে না। আমার এক বন্ধু রেস্টুরেন্টের শেফ। সে গত ১৫ বছর ধরে রান্না করে যাচ্ছে। কই সে তো রান্না করা নিয়ে কোনোদিন অভিযোগ করে নি? কারণ রান্না করতে সে ভালোবাসে।"
স্ত্রী চুপচাপ সব কথা শুনলো।
তারপর বললো,"তোমার শেফ বন্ধু রান্না করার জন্য মাস শেষে বড়ো অংকের টাকা পায়। যদি বলা হয়, এখন থেকে রান্নার জন্য সে কোনো টাকা পাবে না, তাহলে তোমার শেফ বন্ধু ১৫ বছর নয়, ভালোবেসে ১৫ দিনও রান্না করতে রাজি হবে না। আর অফিসেও তোমরা দিনের পর দিন ইচ্ছায় অনিচ্ছায় কাজ করতে পারছো, কারণ মাস শেষে বেতন পাও। যদি বেতন না দেয়া হতো, তাহলে দিনের পর দিন নয়, এক দিনও কেউ অফিসে যেতো না।"
একটু থেমে বললো,"তুমি আজ খুব আগ্রহ নিয়ে রান্না করতে এসেছো আমাকে শেখানোর জন্য যে, রান্না করা কতো সহজ! ঠিক আছে, এখন থেকে তুমি রান্না করবে। প্রতিদিন। সারাজীবন। দেখি রান্নার প্রতি তোমার ভালোবাসা কতোদিন থাকে?"
এই বলে সে চলে গেলো।
বিনা বেতনে সারাজীবন রাঁধতে হবে শুনে বুকে ধক করে উঠলো। একটু আগে প্রবল উৎসাহ নিয়ে পেঁয়াজ কাটছিলাম। কিন্তু এখন কেনো যেনো পেঁয়াজ কাটার আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম। মনে হতে লাগলো, পেঁয়াজ কাটার মতো কঠিন কাজ পৃথিবীতে আর নেই। পুরো রান্নার কথা তো বাদই দিলাম। আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম।
এরপরও আমি চেষ্টা করলাম রান্না করার জন্য। কিন্তু পারলাম না। রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে ঐ মুহূর্তে অনুভব করলাম, বিনা পারিশ্রমিকে দিনের পর দিন রান্নার মতো একটা সময়সাপেক্ষ কাজ করা কী পরিমাণ কঠিন এবং বিরক্তিকর! আর এই কঠিন এবং বিরক্তিকর কাজটি মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে করতে করতে কারো মধ্যে যদি ক্লান্তি চলে আসে, অনীহা চলে আসে এবং সে যদি সে কাজ থেকে একটুখানি বিরাম চায় তাহলে কি তাকে কাজ চোর, বিলাসী কিংবা অবিবেচক বলা যাবে? বরঞ্চ যারা মেয়েদের এসব বলে তারাই মূলত কাজ চোর, বিলাসী এবং অবিবেচক।
রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ধীর পায়ে বেড রুমে এলাম। দেখি সেখানে স্ত্রী নেই।
সাত বছরের মেয়েটাকে বললাম,"তোমাদের মা কোথায়?"
মেয়ে বললো,"মা বারান্দায় বসে আছে।"
বারান্দায় গিয়ে দেখি স্ত্রী মন খারাপ করে বসে আছে।
পাশে গিয়ে বললাম,"রেডি হয়ে নাও।"
সে বললো,"কীসের জন্য?"
"ডিনার বাইরে করবো।"
তারপর বললাম,"তোমাকে বুঝতে না পারার জন্য দুঃখিত।"
স্ত্রী কিছু বলতে গেলে থামিয়ে বললাম,"কিছু বলতে হবে না। প্লিজ রেডি হয়ে নাও।"
স্ত্রী তবু বললো,"বাইরে খেলে তো প্রচুর টাকা খরচ হবে। তোমার খারাপ লাগবে না?"
"ওটা আসলে কোনো সমস্যা না। কারণ এরচেয়ে আরো বেশি টাকা আমরা বন্ধুরা আড্ডা ফাড্ডা দিয়ে নষ্ট করে ফেলি।"
রেস্টুরেন্টে খেতে বসে আমার সাত বছরের মেয়ে, আর দশ বছরের ছেলেকে বললাম,"তোমাদের মা আমাদের প্লেটে প্রতিদিন খাবার তুলে দেন। আজ আমরা তিনজনে মিলে তার প্লেটে খাবার তুলে দেবো।"
ছেলেমেয়েরা হইহই করে মায়ের প্লেটে খাবার তুলে দিতে লাগলো। স্ত্রী 'আর দিও না, আর দিও না' বলে লাজুক হাসছে। আমি মুগ্ধ হয়ে তাদের দেখতে লাগলাম। আর আনন্দ নিয়ে স্ত্রীর প্লেটে খাবার তুলে দেয়ার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।
Love
1
Search
Categories
Read More
Shopping
Dior Shoes he decided to show them for the first time
Apart from any beachside activities, packing and planning for balmy evenings out is equally...
By Vienna Bauer 2024-05-28 06:55:11 0 3K
Other
গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামো নিয়ে যা জানালো আইসিটি বিভাগ
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোর সঙ্গে জনগণের তথ্য প্রাপ্তি সংক্রান্ত অধিকার ব্যাঘাত হওয়ার কোনো...
By Ekattor Television 2022-11-02 12:55:33 0 3K
Other
The Benefits of Visiting Bumrungrad Hospital Dhaka Office for Medical Advice
Living in Dhaka and facing a health concern can be a worrying experience. Navigating the...
By Thaimedi Xpress 2024-10-20 07:48:01 0 4K
Art
Cdg Hoodie & Eric Emanuel Hoodie Perfecting Urban Fashion
Urban fashion, once a niche movement born on the streets, has evolved into a global phenomenon...
By Stussy Apperal 2024-11-05 04:58:56 0 1K
Food
Delicious Snack Boxes / Sandwich Packing Bags
One of a kind additional items for nibble boxes can hoist the general insight, making them more...
By Packlim USA 2024-10-07 10:19:26 0 2K