প্রাণীরা কি অন্যদের ভাষা বুঝতে পারে

0
4K

ধরুন, একদিন কথা বলে উঠল আপনার পোষা কুকুর কিংবা বিড়ালটি। অথবা ডেকে উঠল অ্যাকুরিয়ামে থাকা মাছগুলো। চমকে উঠবেন নিশ্চয়ই! হয়তো ভাববেন, কোনো অলৌকিক ঘটনা ঘটছে। বাস্তবে এমনটা না ঘটলেও এমন কিছু উদাহরণ আছে, যেখানে প্রাণীরা মানুষের ভাষা বুঝতে পারছে বলে মনে হয়। শুধু যে বুঝতে পারে, তা নয়; ওরা নকলও করতে পারে মানুষের কথাবার্তা। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, আমাদের আশপাশের প্রাণীরা কি আমাদের ভাষাও বোঝে? এর পেছনে সত্যিকারের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে কি? নাকি পুরোটাই কাকতালীয়?

বুদ্ধিমান ক্লেভার হ্যানস

বিশ শতকের গোড়ার দিকে জার্মানিতে একটা বিখ্যাত ঘোড়ার নাম ছিল ক্লেভার হ্যানস। এই ঘোড়া জনসাধারণকে হতবাক করে দিয়েছিল। কারণ, ঘোড়াটার মালিক ভিলহেল্ম ভন অস্টেন দাবি করতেন, হ্যানস জার্মান ভাষা বোঝে। প্রয়োজনের সময় বলতে পারে, এমনকি সমাধান করতে পারে গাণিতিক সমস্যাও। তাঁর এই দাবি পরীক্ষা করে দেখেন মনস্তত্ত্ববিদ অস্কার ফাংস্ট। তিনি বুঝতে পারেন, ক্লেভার হ্যানস আসলে প্রশিক্ষকের অজান্তেই তাঁর শরীরিভাষা বা বডি ল্যাংগুয়েজ অনুসারে প্রতিক্রিয়া করছিল। কিন্তু প্রকৃত অর্থে সে মানুষের ভাষা বুঝতে পারত না বা অঙ্ক জানত না। সেটা ছিল ১৯০৭ সালের কথা।

এই ঘটনার বহু পরে, আজও গবেষকেরা প্রাণীদের মানুষের ভাষা বোঝার সীমা যাচাই করে চলেছেন। তবে ক্লেভার হ্যানসের মতো উদাহরণগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়, কাজটা কতটা কঠিন হতে পারে। কিন্তু কিছু প্রাণী কি সত্যিই ব্যতিক্রম হতে পারে?

১৯৬০ ও ৭০-এর দশকে প্রাইমেট বা বানর শ্রেণির প্রাণী, পাখি ও ডলফিনসহ বিভিন্ন প্রাণীর ভাষা সংক্রান্ত গবেষণার প্রসার ঘটে। কিন্তু পরে অনেক সমালোচক বলেন, এই প্রাণীগুলো কেবল প্রশিক্ষকের শরীরিভাষা এবং কণ্ঠস্বর অনুকরণ করছিল, বুঝে কিছু করেনি। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কিছু প্রাণী মানুষের ভাষার নির্দিষ্ট শব্দ এবং অর্থ বুঝতে পারে। তবে ভাষার ব্যাকরণ নিয়ে এখনো রয়েছে অনিশ্চয়তা। জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাইমন ডব্লিউ. টাউনসেন্ড বলেন, ‘মানুষ অনেক দিক থেকেই অনন্য। ভাষা তার মধ্যে অন্যতম। কিন্তু এখন আমরা বুঝতে পারছি, প্রাণী ও মানুষের যোগাযোগব্যবস্থার মধ্যে বেশ কিছু মিল আছে।’

প্রাইমেটরা কি মানুষের ভাষা শিখতে পারে?

ভাষাশিক্ষা পরীক্ষার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত পরীক্ষাটি করা হয় কোকো নামে একটি মাদি গরিলার ওপর। কোকো আমেরিকান সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের ১ হাজারটি সংকেত ব্যবহার করতে পারত এবং প্রায় ২ হাজার ইংরেজি শব্দ বুঝে সাড়া দিতে পারত। ২০১৮ সালে এই মাদি গরিলা মারা যায়। তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, কিছু সাংকেতিক ভাষা শেখা আর সত্যিকারের সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ বা ইশারা-ভাষা আয়ত্ত করা সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। কোকো তার ধারে কাছেও ছিল না। সমালোচকেরা বলেন, কোকো কখনোই সত্যিকারের সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ আয়ত্ত করতে পারেনি। এমনকি অনেক সময় কোকোর সংকেতগুলো ছিল অসঙ্গতিপূর্ণ।

আরেকটি বিখ্যাত বানর শ্রেণির প্রাণী—আসলে গরিলা—কাঞ্জি। এটি একটি পুরুষ বোনাবো। ১৯৮০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত বেঁচে ছিল এই বোনাবো। কাঞ্জি নাকি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে উন্নততর ভাষা বুঝতে পারত। ওটা একটা লেক্সিগ্রাম বোর্ড ব্যবহার করে প্রতীকের সাহায্যে যোগাযোগ করত। লেক্সিগ্রাম বোর্ড হচ্ছে পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ প্রায় ২০০টি বিচ্ছিন্ন প্রতীকের একটি কিবোর্ড। কাঞ্জির সঙ্গে কাজ করেছিলেন সাইমন টাউনসেন্ড। তিনি বলেন, ‘কাঞ্জি বোর্ডের প্রতীকগুলো চিনত এবং নাম, জায়গা, বস্তু ও কাজ সম্পর্কে বোঝাতে পারত। এমনকি হ্যাঁ কিংবা নাও বোঝাতে পারত।’

কাঞ্জি নামে গরিলা

তবে মানুষের ভাষা কেবল প্রতীকেই সীমাবদ্ধ নয়। কাঞ্জির প্রতীক ব্যবহারে কিছু যুক্তিগ্রাহ্যতা ছিল ঠিক, কিন্তু সে প্রকৃত বাক্যগঠন বোঝে কি না, তা নিয়ে বিতর্ক আছে বলে মনে করেন অধ্যাপক টাউনসেন্ড।

তবে ১৯৯৩ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, কাঞ্জি নতুন বাক্য শুনে ৭৫ শতাংশ ক্ষেত্রে ঠিক কাজ করতে পারত। যেমন ‘পুট অন দ্য মনস্টার মাস্ক অ্যান্ড স্কেয়ার লিন্ডা’—অর্থাৎ ‘দানবের মুখোশ পরে লিন্ডাকে ভয় দেখাও’ বললে সে ঠিকই মুখোশ পরে লিন্ডাকে ভয় দেখাত। তখন সে একটি আড়াই বছর বয়সী শিশু থেকেও ভালো সাড়া দিত।

কুকুর কি মানুষের কথা বুঝতে পারে

কুকুর অন্তত ১৪ হাজার বছর ধরে মানুষের সঙ্গে বাস করছে। ফলে ওদের মধ্যে একধরনের ‘ভাষা সংবেদনশীলতা’ তৈরি হয়েছে। কুকুর মানুষের কণ্ঠস্বর, সুর এবং অঙ্গভঙ্গির প্রতি খুব সংবেদনশীল। এরা ৮ সপ্তাহ বয়স থেকেই মানুষের কণ্ঠস্বর এবং অঙ্গভঙ্গিতে আগ্রহ দেখায়। গবেষণায় দেখা গেছে, ওরা অগোছালো ভাষা ও সাধারণ ভাষার পার্থক্য বুঝতে পারে।

বিশ্বের সবচেয়ে বুদ্ধিমান কুকুর চেসার

এখন পর্যন্ত পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান কুকুর বলে পরিচিত চেসার। এটি প্রায় হাজারখানেক শব্দ রপ্ত করেছিল। ২০১১ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, চেসার বিভিন্ন নির্দেশের পার্থক্য বুঝতে পারত। যেমন ‘ব্রিং দ্য সক টু দ্য বল’—অর্থাৎ, ‘বলটির কাছে মোজা আনো’; এবং ‘ব্রিং দ্য বল টু দ্য সক’ বা ‘মোজার কাছে বল আনো’—এই বাক্য দুটির পার্থক্য কুকুরটা বুঝত। এ ঘটনা বেসিক সিনট্যাক্স বা ভাষার মূল কাঠামো বোঝার ইঙ্গিত দেয়। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ফেডরিক রসানো বাটন বোর্ড ব্যবহার করে কুকুরদের ভাষা বোঝার ক্ষমতা যাচাই করেন।

২০২৪ সালে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, কুকুর মালিকের নির্দেশনা ছাড়াও ‘আউটসাইড’, ‘প্লে’ কিংবা ‘ফুড’—এ ধরনের শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কাজ করে। এমনকি কোনো প্রসঙ্গ না থাকলেও। যেমন আউটসাইড বললে ওরা দরজার দিকে বা প্লে বললে খেলনার দিকে ছুটে যায়। এই গবেষণা দেখায়, সূত্র বা প্রসঙ্গ ছাড়াও কুকুর শব্দের বিষয় ধরতে পারে। তবে শব্দের সূক্ষ্ম পার্থক্য, যেমন ‘সিট’ এবং ‘সেট’, বোঝার ক্ষেত্রে এদের সীমাবদ্ধতা আছে।

 

রসানো বলেন, ‘কুকুর যে কথা বুঝতে পারে, তা প্রমাণ করা আমার উদ্দেশ্য নয়; বরং ভাষাগত দক্ষতার মৌলিক দিকগুলো খুঁজে বের করাই আমার উদ্দেশ্য। যদিও এখনো অনেক প্রশ্নের উত্তর জানা বাকি।’

এসব ঘটনা জানার পরে আপনার নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছে করছে, প্রাণীরা কি আমাদের ভাষা বুঝতে পারে? চাইলে কি অন্য প্রজাতির ভাষা শেখা সম্ভব? এ প্রশ্নের উত্তর আমরা এখনো জানি না। তবে যে সম্ভাবনাগুলো আছে, তা নিঃসন্দেহে কৌতূহল জাগানোর মতো।

লেখক: সাংবাদিক ও অনুবাদক

সূত্র: লাইভ সায়েন্স

Cerca
Categorie
Leggi tutto
Home
Raheja Jade City: Redefining Community Living
Raheja Jade City is more than just a residential project—it's a self-sustained urban...
By Divya Gupta 2025-08-06 10:48:17 0 1K
Altre informazioni
U.S. Health And Wellness Market Size, Share, Trends 2025-2034
According to Cervicorn Consulting, the "U.S. Health And Wellness Market" is projected to...
By Sahil Rane 2025-06-16 17:52:02 0 3K
Health
RiseFuel 400mg Capsules Avantages, prix et ingrédients actifs
RISEFUEL est un complément alimentaire premium pour hommes, formulé pour...
By RISEFUEL MaleEnhancement 2025-08-21 09:43:52 0 525
JogaJog https://jogajog.com.bd